তীরে ফেরা ঢেউ (পর্ব- ৬)

অনিন্দিতা গুড়িয়া,

নিউ-দিল্লি


পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য লাইব্রেরি বিভাগে দেখুন...

উর্মিলা যখন বারান্দা থেকে ঘুরে দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে যাবে, উর্মীর সাথে প্রায় মুখোমুখি ধাক্কা।

- কিরে তুই কতক্ষণ! তোর চোখ মুখ এমন লাল লাল দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে তোর? খাবার খেয়েছিস তো? আমি স্বপ্নাকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম.....

- আমাকে দেখে খুব অবাক হলে! নাকি চমকে গেলে, কোনটা মা?

- আরে, দুর পাগলী অবাক হবো কেনো! আর চমকেই বা যাব কেন!

- আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে মা?

- হ্যাঁ, কেন দেব না! বল কি জানতে চাস.....

আচ্ছা তার আগে ঘরে তো ঢুকতে দিবি নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর শুনবি।

উর্মি দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়, উর্মিলা ঘরে ঢুকে সবার আগে বাথরুমে চলে যায়। তারপর বাইরের কাপড় ছেড়ে হাত-পা মুখ ধুয়ে ঘরের পোশাক পরে রান্নাঘরে গিয়ে দু কাপ চা বানায়। তারপর চা বিস্কিট আর তিলের নাড়ু এনে দুই মা মেয়ে মুখোমুখি বসে।

চায়ে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে উর্মিলা বলে
- বল কি জানতে চাস, তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেবো আমি।

- এসব কি হচ্ছে, আমায় একটু খুলে বলবে প্লিজ?

উর্মিলা হেসে বলল- কোথায় কি হচ্ছে? খুলে বলারই বা আছেটা কি, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

- এটা কোন হাসির কথা নয় মা, আমি সিরিয়াসলি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি। যদিও সবটাই তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এসব প্রশ্ন করা আমার সাজে না। আমি নিজে একজন স্বাধীনচেতা মানুষ তাই আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষের তার নিজের ইচ্ছা মত বাঁচার অধিকার আছে। কিন্তু নিজের বয়সের কথাটাও তো মাথায় রাখবে!

- আচ্ছা আচ্ছা বুঝতে পেরেছি, আমি সারাদিন বাড়িতে ছিলাম না, তোর দুপুর বেলা ঠিকমতো খাওয়া হয়নি, তাই মেয়ের আমার গোঁসা হয়েছে।

- শুধু আজকের কথা নয় মা, আমি বাড়ি তে এসে ইস্তক দেখছি রোজই তুমি বেরোচ্ছে! রোজ রোজ তুমি কোথায় যাও? আর আজ তো সব সীমাই অতিক্রান্ত। সেই কোন সকালে বেরিয়েছ আর এখন প্রায় বিকেল....আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম। তুমি কি খাবে, না খাবে, সেসব কি চিন্তাভাবনা রেখেছো? নিজের শরীরটাকে খারাপ করার ইচ্ছে আছে?

ওরে আমার পাগল মেয়ে, এই তাহলে তোর গোঁসার আসল কারণ? আমার শরীর একেবারে ঠিক আছে, ও নিয়ে তুই চিন্তা করিস না।

এই নিয়ে দু- দুবার তুমি আমাকে এই কথা বললে, আমি ছাড়া কি চিন্তা করার জন্য আরও কেউ আছে নাকি তোমার?

উর্মিলা হেসে বলল- হ্যাঁ, সেটা তুই বলতেই পারিস। আগে আমার জন্য চিন্তা করার জন্য শুধুমাত্র তুই ছিলি, এখন আরো একজন হয়েছে। সে ও একটু আধটু চিন্তা করে আমার জন্য।

হেঁয়ালি করা রেখে আমায় খুলে বলবে সবকিছু? আর একটু আগেই বাইক নিয়ে যে বেরিয়ে গেল কে সে!

ও......তুই সৈকত কে দেখেছিস? ওই পাগলটার জন্যই তো আজকে আমার ফিরতে এত দেরি হল। পাগলটা আমাকে আগে থেকে বলেই নি যে আজকে ওর জন্মদিন। ওতো নিমকি আমায় সময় থাকতে জানিয়েছিল, তাই আমি জেনেছিলাম যে আজ সৈকতের জন্মদিন। আর, কারো জন্মদিন জেনে বুঝে চলে আসা যায়, তুই বল! এটা কি উচিত? তাই তো নিজের হাতে একটু পায়েশ রেঁধে ওকে খাইয়ে তবেই আসতে পারলাম।

পরের জন্য তো তোমার খুব দুখ দরদ, তাই না মা! এদিকে নিজের মেয়েটা কি খাবে না খাবে সে সব চিন্তা ভাবনা নেই। ও তোমার কে হয় মা?

ও আমার কে হয়......থাক, সে বলার সময় এখনো আসেনি। ও তুই আপনিই জানতে পারবি। আর তুই তো না খেয়ে নেই, তোর খাবারের ব্যবস্থা তো আমি করেই দিয়েছি।

হ্যাঁ সে তো করেইছ, স্বপ্না মাসি কে ফোন করে উদ্ধার করেছ আমায়। তুমি ভালোই জানো স্বপ্না মাসির হাতের ওই ট্যালট্যালে ডাল আর পানসে ঝোল আমি এক্কেবারেই খেতে পারি না, তাও আজকে খিদে জ্বালায় সেগুলোই গলদ্ধকরণ করতে হলো। আর অন্যান্য বারে রান্না ঘরের কৌটো বাটি সব ভরা থাকে। তিলের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, লবঙ্গ লতিকা, জিভে গজা, নিমকি, চিড়ে বাদাম ভাজা আরও কত কিছু তুমি বানিয়ে রাখো আমার জন্য। এবার তোমার কি হয়েছে বলোতো মা! আমি আসাতে মনে হয় তোমার একটু বেশিই অসুবিধা হচ্ছে তাই না? ঠিক আছে জাস্ট একটা ফোন লাগবে। একবার ফোন কল করাতেই আমার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এবার কিন্তু একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে উর্মি, তুই আসাতে আমার অসুবিধা হবে, এ কথা তুই বলতে পারলি! সন্তান মায়ের কাছে যে কি জিনিস, সন্তানকে কাছে পাবার মায়ের যে কি ভীষণ আনন্দ সে তুই বুঝবি না। এত বছর ধরে বলে যাচ্ছি, বিয়ে, সন্তান, সংসারটা ও তুই ঠিক মতো করলি না। তোকে এসব বোঝানো বৃথা।

আমার কাছে ক্যারিয়ার টাই সব, আমার কাছে ওসব ছেঁদো আবেগের কোন মূল্য নেই, সেটা তুমি বেশ ভালই জানো মা। বিয়ে সংসার সন্তান সে তো তুমিও নিয়েছিলে কিন্তু কি পেয়েছো বলো তো মা! চিন্তা করে দেখেছো কখনো, বাবা মারা যাওয়ার পর কিভাবে আমাদের দিন কেটেছে! কত কষ্ট করে তুমি আমাকে মানুষ করেছো! কিন্তু সেদিন যদি তোমার হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা থাকতো তাহলে কি এই কষ্ট আমাদেরকে ভোগ করতে হতো?

উর্মি!!! চুপ কর উর্মি, চুপ কর, আমি আর নিতে পারছি না। সুহাস আমাকে ধোঁকা দেয়নি, আমি তো সব জেনে বুঝেই সুহাসের হাত ধরেছিলাম। সুহাস আজীবন আমাদেরকে ভালোবেসে গেছে আগলে রেখে গেছিল। সুহাস যে এভাবে চলে যাবে, সুহাস নিজেও কি জানতো? খুব ছোটবেলার তোর সব কথা হয়তো তোর মনে নেই, আমৃত্যু স্বামী হিসেবে অথবা বাবা হিসেবে সে তার কর্তব্যে কার্পণ্য করেনি এতটুকু।

বাবার বা তোমার যা ডিগ্রী ছিল তাতে করে শহরে থেকে খুব ভালো চাকরি বাকরি করে নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করে আমাকে ভালোভাবে মানুষ করতেই পারতে তোমরা। কিন্তু তা না করে বাবা নিজের আদর্শের জন্য শহরের জৌলুস, সুলভ পরিষেবা, ভালো চাকরির হাতছানি, সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে একটা নাম পরিচয়হীন গন্ডগ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হয়ে বসলো। আর তুমিও তোমার সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে তার স্ত্রী হয়ে গ্রামে বসে হাঁস মুরগি প্রতিপালন করতে শুরু করলে। কোন মাসে বাবার মাইনে হয় তো কোন মাসে হয় না। কোন রকমে ক্ষেতের সবজি, হাঁস মুরগির ডিম, এইসব বিক্রি বাটা করে আমাদের দিন চলত। তার উপরে সন্ধ্যে হলেই নিজের ঘরে বাতি জ্বালানোর তেল থাক বা না থাক, পাড়ার গাদা গুচ্ছের বাচ্চাদেরকে বারান্দায় বসিয়ে মুড়ি তেলে ভাজা খাইয়ে হারিকেনের আলোয় সর্বশিক্ষা অভিযানের পালা চলত। কি হলো শেষমেষ, সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল গ্রামবাসীরা? নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে সবকিছু কে ছেড়েছুড়ে সেই তো পালাতে হলো। গ্রামের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিনা চিকিৎসায় নিজে তো পরপারে গেলেন সাথে তোমাকে আর আমাকেও দুর্দিনের ঘোলা জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। সেদিন যদি তুমি আমার হাত ধরে শহরে না আসতে তাহলে কি ওই গ্রামে বসে তুমি আমাকে মানুষ করতে পারতে? কবেই আমরা মা-মেয়ে দুজনে মরে ভূত হয়ে যেতাম, সে কথা ভেবে দেখেছো?

তোর প্রতিটা কথাই সত্যি এক বর্ণও মিথ্যা নয়, কিন্তু সুহাসের আদর্শকে আমি সম্মান করি উর্মি। সুহাসের হঠাৎ করে এই চলে যাওয়াটাই আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল রে, সুহাস থাকলে আমাদের অত কষ্ট পেতে হতো না।

আমার এই ঊন পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি সমাজ সংসার আমি কম দেখলাম না মা, স্বামী থাকা সত্ত্বেও কত মহিলারা যে অসহায় সেটা তুমি বেশ ভালোই জানো। আজকাল আকছার ডিভোর্স হচ্ছে, কত স্বামী রা ঘরে স্ত্রী রেখে বাইরে অ্যাফেয়ার করে বেড়ায়, স্ত্রীর হাতে টাকা পয়সা দেয় না। এমন কত সন্তান আছে যারা প্রতিনিয়ত মা-বাবাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, হেনস্থা করে, খাবার দেওয়া তো দূরে থাক। আমি সেই সব পাকে পড়তে চাইনি। আমার কাছে ভালো ডিগ্রী আছে, ভালো ক্যারিয়ার আছে, সন্মান আছে, ভালো টাকা পয়সা আছে। একজন মানুষের জীবনে এর থেকে আর বেশি কি দরকার?

ওরে পাগল মেয়ে ডিগ্রী টাকা পয়সা জীবনের সব নয়, ভালোবাসার মানুষও দরকার। জীবনে দুঃখ- যন্ত্রণা, টানা-পোড়েন, ওঠা -পড়া সবকিছুই থাকবে। কিন্তু এমন একজন দরকার যার মধ্যে তুই শান্তি খুঁজে পাবি। আর সন্তানের কথাই যদি বললি তবে বলব সব সন্তান খারাপ হয় না, এমন সন্তানও আছে যারা নিজের মায়ের সাথে সাথে আরো কারুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। তার একটা জ্বলন্ত উদাহরণ দেব? এই যে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমার রণরঙ্গিনী মা চন্ডী উর্মি।

আহ মা তেল দেওয়াটা একটু কম করো তো, আমার ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা ঝগড়া খুনসুটি সবকিছুর জন্য তুমি তো আছই, আমার তো ভালোবাসার কোন কম হচ্ছে না। আর শান্তি খোঁজার দিন এখনো আসেনি।

ওরে পাগল মেয়ে, আমারও তো বয়স হচ্ছে, আমি কি আর চিরকাল তোকে এইভাবে ভালবাসতে পারব? আমার পরে তোর বাকি জীবনটা কিভাবে কাটবে, ভেবে দেখেছিস?

স্বপ্নমাসী, সিধু মামার কে আছে, তাদের জীবন কি কাটছে না?

ওরা তোকে ঘিরে বেঁচে আছে, আমি হয়তো তোকে জন্ম দিয়েছি কিন্তু ওরাও তোকে নিজের সন্তানের মতই স্নেহ করে ভালবাসে। ওদের জীবনে যেমন একটা উর্মি আছে তেমন তোর জীবনেও কাউকে থাকার দরকার ছিল।

তোমার এই পাতি সেকেলে চিন্তা ভাবনায় বার বার করে আমাকে বিয়ে সন্তান সংসার এসব বলে বলে মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিলে জাস্ট, যার জন্যই আমি জিহানকে এক্সেপ্ট করেছিলাম। কিন্তু কি হলো! ছাড়ো এসব কথা, কি কথা থেকে কি কথায় এলাম। তবে তোমার যা মতিগতি দেখছি তাতে করে এবার শান্তির খোঁজে সত্যিই বোধহয় আমাকে বেরোতে হবে।

কথায় বলে 'জন্ম মৃত্যু বিয়ে, তিনি বিধাতা নিয়ে'। বিধাতা যদি তোর পাশে জেহানকে না রাখতে চান তুই যতই চেষ্টা কর কিছুই হবে না।

কি বলতে চাইছো তুমি? বিধাতা কার জন্য আমাকে লিখেছেন? যতসব ফালতু কথা তোমার।

বলেই সোফা থেকে উঠে দুমদাম পা ফেলে পিছনের দিকের বারান্দায় চলে যায় উর্মি। আজ দুপুর থেকে ওর মনের ভেতর যে উথাল পাথাল চলছে সেটা ও যেন কোনোভাবে চাপতে পারছে না। পাছে মায়ের সামনে ধরা পড়ে যায় তাই ওইভাবে উঠে চলে আসে উর্মি। পিছন থেকে মা উর্মিলা বলেন-

আচ্ছা আচ্ছা, তোর তিলের নাড়ু, নারকেল নাড়ু, চিড়ে ভাজা, বাদাম ভাজা, নিমকি এসব বানিয়ে দিলেই হল তো! ঠিক আছে, আজই আমি সব বানিয়ে দেবো।

নিজের ভেতরের উত্তাল ঢেউ কে একটু স্থিমিত করে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে উর্মি আবার ঘরের ভেতর ঢুকে আসে আর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
ও হ্যাঁ, নিমকির কথা তুলতেই আমার মনে পড়ল। একটু আগেই বললে না নিমকি না কে একটা মেয়ে আজকে তোমার সৈকতের জন্মদিনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল। তা এই নিমকি টা কে?

নিমকি- দুলকি দুই বোন, লোকের বাড়ি থেকে কাচড়া উঠায়। গাঁট্টা- আলু দুই ভাই, কুড়ার ঢের থেকে প্লাস্টিক টিন টাপ্পড় লোহা বোতল শিশি ছেঁটে বের করে। পচা, গোবলু, সনু, তিনজন ওরা রেললাইন থেকে ডিসপোসেবল জলের বোতল কুড়ায়। মিঠু আর ছোটু চায়ের দোকানে কাপ ডিশ ধোয়, দোকানদারের ফাই -ফর্মাস খাটে। এরকম আরো গোটা 25 বাচ্চা আছে, ওদের প্রত্যেকেরই বয়স তিন বছর থেকে ১৩-১৪ বছর, ওরা সকলেই খালপাড়ের বস্তিতে থাকে। আর আজ যাকে দেখলি বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতে, ও অর্থপেডিক সার্জন ডক্টর সৈকত। ওই বস্তির একটা ঘরে আমরা বাচ্চাগুলোকে পড়াই, অবশ্য শুধু পড়ালে তো আর ওরা কেউ আসবে না, তাই খাবারও খাওয়াই, আর তার সাথে সাথে পড়াশোনাও করাই। যাতে অন্তত সমাজের মূল স্রোতে ওরা মিশতে পারে। কারণ ওইসব বস্তি থেকেই তো উঠে আসে যত গুন্ডা বদমাইশ চোর ছ্যাচঁড়ের দল।

তোমাদের স্কুলটার নাম কি? কে কে পড়াও তোমরা ওখানে? আমাদের স্কুলটার নাম পাঠশালা। আচ্ছা তোকে আজকে কি সবটাই জানতে হবে? আয় তো দেখি, চুল গুলোর কি অবস্থা করেছিস! মাথায় একটু তেল লাগিয়ে দিই আয় আমার কাছে এসে বস।

ব্যাস উর্মিলার এই কথাতেই কাজ হল, উর্মির মনের যত রাগ দ্বন্দ্ব অভিযোগ সবকিছু এক নিমিষে মিটে গেল। কিন্তু তাও মায়ের সামনে কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলল-
আদিখ্যেতা রাখো! সন্ধে প্রায় উত্তীর্ণ, আজ আর আমার মাথায় তেল লাগিয়ে কাজ নেই। তুমি বরং ওঠো। সন্ধে বাতি দিয়ে একটু কিছু পেটে দেওয়ার জোগাড় করো। সেই কোন দুপুর বেলা স্বপ্না মাসির ওই ট্যালট্যালে ডাল আর বিচ্ছিরি পানশে ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। পারলে এখন একটু মুড়ি মেখে দাও আমায়, আমি আমার অফিসের কাজ নিয়ে বসছি একটু।

বেডরুমে বিছানার ওপরে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে কাজ করার জন্য বসলো উর্মী। কিন্তু ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে মনটা বারবার কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে, কাজে মন বসছে না কিছুতেই। মনের ভিতর কতরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ দুপুর থেকেই ওর মনটা একেবারে অন্যরকম লাগছে এই অনুভূতিটা এর আগে কখনো হয়েছে বলে ওর মনে পড়ছে না তার উপরে মায়ের স্বামী সন্তান সংসার এই কথাগুলো যেন বুকের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত কেউ ধারালো কিছু দিয়ে চিরে দিয়ে যাচ্ছে। আজ বড্ড মনে পড়ছে অর্ণবকে, বড্ড মনে পড়ছে তার নিজের নাড়ী ছেঁড়া ধনের কথা। যেসব কথা অতি গোপনে অতি সযতনে রক্ষিত আছে ওর মনের গহীনে। সেই কবেকার কথা, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগের সে সব দিন যেন আজও চোখের সামনে একেবারে স্পষ্ট। আর এই মাত্র বছর দশেক আগে জেহানের সঙ্গে সংসার পাতার চিন্তা করে বিয়েও করেছিল উর্মি, কই আজকে তো জেহানের কথা সেই ভাবে মনে পড়ে না! জেহানের স্মৃতি যেন বড্ড আবছা, মলিন। কানে এলো শঙ্খ ধ্বনি, উর্মি বুঝতে পারল মায়ের সন্ধ্যা বাতি ধরা হলো। এইবারে মা আসবে মুড়ি মাখা নিয়ে, তার আগেই নিজেকে একটু ধাতস্থ করে নিল উর্মি।

একটু পরে মা উর্মিলা ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ দেখিয়ে শাঁখ বাজিয়ে তারপর একটা বাটিতে করে মুড়ি মেখে নিয়ে এসে উর্মীর সামনে রাখে।

মা, তোমার ফাইফরমাস খাটার জন্য মালতি বলে একজনকে রেখেছিলে না? আমি তো এসেছি ২-৩ দিন হয়ে গেল। কই তাকে তো একদিনের জন্য দেখলাম না!

তুই তাকে দেখবি কি করে, তুই তো আটটার পর ঘুম থেকে উঠছিস। ভোরবেলা সাড়ে পাঁচটায় মালতি ঢোকে আর সাড়ে সাতটায় বেরিয়ে যায়।

আচ্ছা মা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ভেবো না আমি অভিযোগ করছি বা কৈফিয়ত চাইছি আজ দুপুর বেলা স্বপ্না মাসির থেকে শোনার পর থেকে মনের ভেতরটা খুব আনচান করছে, বল না মা, সৈকতের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? মাসি যা বলছে তাই কি সত্যি?

দেখ্ স্বপ্না তোকে কি বলেছে না বলেছে আমি জানিনা। তবে এ ও বেশ বুঝতে পারছি যে এমন কিছু বলেছে যার জন্য তুই বারবার আমাকে এই প্রশ্নটিই করছিস।সপ্নার ওই এক স্বভাব, তিলকে তাল করার অভ্যেসটা আর গেল না।

আদুরে গলায় উর্মি বলল স্বপ্নমাসি যা বলেছে সে সব ভুলে যাও মা, তুমি আমায় বলো না মা, সৈকত তোমার কে হয়?

এই অযাচিতভাবে কোন কিছু জানার আগ্রহ তো তোর মধ্যে আগে কখনো দেখিনি! সময় হলে সব জানতে পারবি। শুধু এইটুকু বলতে পারি, ওর আর আমার সম্পর্ক ঈশ্বর তৈরি করে পাঠিয়েছেন। সে সম্পর্ক ভাঙার সাধ্যি কারো নেই।

ভাঙতে তো আমি চাইছিনা মা! বরাবর বাবার সাধ আমার ছিল, সে তুমি ভালই জানো। উর্মির কথা শেষ হয় না তার আগেই অট্টহাসিতে গড়িয়ে পড়েন মা উর্মিলা। হাসতে হাসসেতিয়ে-

হ্যাঁ বাবা.......বাবাই বটে। যা মুড়িগুলো খেয়ে উদ্ধার কর, বোধহয় সেঁতিয়ে গেল এতক্ষনে। পাগলি মেয়ে কোথাকার। আমি রান্না ঘরে গেলাম.....

ক্রমশ..............