স্মৃতির শঙ্খচিল

রীতা বিশ্বাস পান্ডে,

দিল্লি

(গল্পটি হারানো প্রেম ও স্মৃতির বোঝা বহন করার ইঙ্গিত দেয়)

রত্নদ্বীপ আর সোমলতার প্রথম পরিচয় শহরের খুব দামী একটি পানশালাতে। যেখানে রত্নদ্বীপ একা বসে পান করছিল আর সোমলতা তার ছেলেবন্ধুর সাথে চাপাস্বরে পান করার মাঝে মাঝে ঝগড়া করছিল। যদিও রত্নদ্বীপের কান সব শুনতে পাচ্ছিল। রাতের মাতাল কোলাহল ছাপিয়েও সোমলতার চাপা কণ্ঠস্বর রত্নদ্বীপের কানে স্পষ্ট আসছিল। কাঁচে বরফ ঘষার শব্দের চেয়েও তীক্ষ্ণ সেই ঝগড়ার সুর, যেন কোনো বেহালায় বেসুরো তার বাজছে। রত্নদ্বীপ দেখল, সোমলতার চোখ ছলছল করছে, আর তার পাশে বসা তথাকথিত 'ছেলেবন্ধু'টি নির্বিকার ভঙ্গিতে গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। রত্নদ্বীপের বুকের গভীরে বহু বছর ধরে সুপ্ত থাকা এক অব্যক্ত বেদনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙতে এগিয়ে গেল।

"কিছু বলবেন?" সোমলতা রত্নদ্বীপের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল, তার কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট বিরক্তি।

রত্নদ্বীপ মৃদু হাসল। "আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি খুব একটা ভালো নেই।"

সোমলতা এবার তাকাল। তার চোখগুলো গভীর, যেন কোনো প্রাচীন সমুদ্রের তলদেশ। "আপনার কী মনে হয়, ভালো থাকার অনুমতি সবার থাকে?"

রত্নদ্বীপ সোমলতার ছেলেবন্ধুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার সোমলতার দিকে ফিরল। "কিছু কিছু ব্যথা ব্যক্তিগত, আর কিছু কিছু ব্যথা ভাগ করে নিলে হালকা হয়।"

ছেলেবন্ধুটা বিরক্ত হয়ে উঠল। "আরে ভাই, আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাচ্ছ কেন?"

রত্নদ্বীপের মুখে সেই মৃদু হাসি। "ব্যক্তিগত যখন প্রকাশ্যে আসে, তখন তার ওজন কমে যায়। আর প্রকাশ্য ব্যথা কখনো ব্যক্তিগত থাকে না।"
ছেলেবন্ধুটা আর কিছু বলার আগেই সোমলতা উঠে দাঁড়াল। "চলুন, এখান থেকে বের হই।"

রত্নদ্বীপ অবাক হলো। "কোথায়?"

"যেখানে আপনার কথাগুলো ব্যক্তিগত থাকবে।" সোমলতা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। রত্নদ্বীপ একটুও দেরি না করে তাকে অনুসরণ করল। ছেলেবন্ধুটা হতভম্ব হয়ে বসে রইল।

শহরের এক অন্ধকার গলিপথে তারা হাঁটছিল। জনমানবহীন পথ, শুধু দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের কান্নার শব্দ। সোমলতা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।

"আমার নাম সোমলতা।"

"রত্নদ্বীপ।"

"আপনি আমার সম্পর্কে কী জানেন?"

"আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি এমন কিছু বয়ে বেড়াচ্ছেন যা আপনাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।"

সোমলতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। "আর আপনি? আপনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি এমন কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন যাকে আপনি হারিয়েছেন।"

রত্নদ্বীপ হাসল, কিন্তু তার হাসিটা বিষণ্ণ। "আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি জীবনের পথে এমন কিছু হারিয়েছি, যা হয়তো আর কোনোদিন ফিরে পাব না।"

সোমলতা আকাশের দিকে তাকাল। "আমরা সবাই কি হারানো কোনো কিছুর সন্ধানেই ঘুরি না?"
"হয়তো।" রত্নদ্বীপ উত্তর দিল। "হয়তো আমাদের আত্মারা শুধু হারানো স্বর্গের স্বপ্ন দেখে।"
সে রাত ছিল তাদের প্রথম পরিচয়ের রাত। তারপর কত রাত কেটে গেল। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, তারা খুঁজে নিল এক নির্জন কফি শপ, যেখানে তাদের কথাগুলো কখনো শেষ হতো না। সোমলতা রত্নদ্বীপকে তার জীবনের গল্প বলল, তার ছেলেবন্ধুর সাথে তার সম্পর্ক, তার স্বপ্ন, তার ভাঙা হৃদয়ের কথা। আর রত্নদ্বীপ শুনল, শুধু শুনল। তার নীরবতা ছিল গভীর সমুদ্রের মতো, যেখানে সোমলতার সমস্ত কষ্ট ডুবে যেত।

একদিন রত্নদ্বীপ তার গল্প বলা শুরু করল। তার গল্পটা ছিল আরও বিষাদের। সে ভালোবেসেছিল এক মেয়েকে, যে ছিল তার জীবনের প্রতিটি সুরের উৎস। কিন্তু সে মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, এক ঝড়ো বৃষ্টির রাতে, আর ফিরে আসেনি। রত্নদ্বীপের জীবনের প্রতিটি রঙ ফিকে হয়ে গিয়েছিল সেদিন।

"সে চলে গেছে, তাই আপনি কি বেঁচে নেই?" সোমলতা জিজ্ঞেস করল, তার চোখে জল।

রত্নদ্বীপ হাসল। "আমি বেঁচে আছি, কিন্তু আমার অস্তিত্ব নেই। আমি শুধু স্মৃতির জাবর কাটি।"

"স্মৃতি তো কষ্ট দেয়।"

"হ্যাঁ, কিন্তু স্মৃতিই তো প্রমাণ করে যে ভালোবাসাটা ছিল।"

এভাবে দিন কাটতে লাগল। রত্নদ্বীপ আর সোমলতা একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। তারা একে অপরের দুঃখের সাথী হলো, একে অপরের নিঃশ্বাসে মিশে গেল। কিন্তু তাদের সম্পর্কটা ছিল এক অদ্ভুত বাঁধনে বাঁধা, যেখানে ভালোবাসার স্পর্শ ছিল, কিন্তু ছিল না ভালোবাসার অধিকার।

একদিন সোমলতা বলল, "রত্নদ্বীপ, আমি আর পারছি না।"

রত্নদ্বীপের বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল। "কী পারছ না?"

"এভাবে বেঁচে থাকা। এই স্মৃতির বোঝা, এই ভালোবাসার হাহাকার।"

রত্নদ্বীপ তার হাত ধরল। "আমরা তো একে অপরের আশ্রয়।"

সোমলতা তার হাত ছাড়িয়ে নিল। "আশ্রয় ক্ষণিকের, মুক্তিই আসল।"

সেদিন রাতে সোমলতা চলে গেল। কোনো বিদায় না জানিয়ে, কোনো চিহ্ন না রেখে। শুধু এক টুকরো কাগজ, তাতে লেখা ছিল: "কিছু ভালোবাসা এমন হয়, যা শুধু স্মৃতি হয়েই বেঁচে থাকে। আর কিছু মানুষ এমন হয়, যারা শুধু অন্যের দুঃখ কমাতে আসে।"

রত্নদ্বীপ সেই কাগজটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার চোখে জল ছিল না, শুধু এক অপার শূন্যতা। সে বুঝল, সোমলতা ছিল তার সেই হারানো সুরের মতো, যা শুধু অল্প সময়ের জন্য তার জীবনে এসেছিল, আর তারপর মিলিয়ে গেল অনন্তের পথে।

আজও রত্নদ্বীপ সেই পানশালায় যায়, যেখানে সোমলতার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। সে একা বসে থাকে, আর রাতের কোলাহল ছাপিয়ে শোনার চেষ্টা করে সোমলতার চাপা কণ্ঠস্বর, সেই বিষাদের সুর, যা তার জীবনে এক নতুন শূন্যতা যোগ করে চলে গেল। সে জানে, সোমলতা আর ফিরবে না। সে শুধু তার স্মৃতির সাথে বেঁচে থাকে, এক অনন্ত বিষাদের গভীরে, যেখানে প্রেম আর বিচ্ছেদ একাকার হয়ে যায়। রত্নদ্বীপ এখন একা নয়, তার সাথে আছে সোমলতার স্মৃতি, যা তাকে প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়—পৃথিবীতে কিছু গল্প অসমাপ্তই থেকে যায়।

সে রাতের পর বহু বছর কেটে গেছে। রত্নদ্বীপ আর সেই পানশালার অন্ধকার কোণে বসে থাকে না। সোমলতার স্মৃতির বিষণ্ণতা তাকে এখনো ছুঁয়ে যায়, কিন্তু তা এখন আর সর্বগ্রাসী নয়। সে বুঝেছে, কিছু ভালোবাসা এমনই, যা শুধু হৃদয়ের গভীরে এক শান্ত নদীর মতো বয়ে চলে—অদৃশ্য, কিন্তু অমলিন।

আজ সকালে রত্নদ্বীপ এক নতুন সকালে চোখ খোলে। জানালার বাইরে ভোরের আলো খেলা করছে, আর পাখির কলকাকলি জানান দিচ্ছে জীবনের অবিরাম ছন্দের কথা। সে তার জীবনের গল্পটা আবার লিখতে শুরু করেছে। স্মৃতির ভার তাকে আর আটকে রাখেনি, বরং তা হয়ে উঠেছে এক মূল্যবান শিক্ষা। সে শিখেছে, হারানো মানেই শেষ হয়ে যাওয়া নয়; বরং তা এক নতুন শুরুর ইঙ্গিত। হয়তো সোমলতা তার জীবনে এসেছিল, তাকে শেখাতে যে দুঃখের মাঝেও জীবনের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে, আর কিছু সম্পর্ক শুধু অনুভব করার জন্যই। রত্নদ্বীপ জানে, সোমলতা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক। আর সেও তার বিষণ্ণতার ছায়াতলে খুঁজে নিয়েছে এক নতুন দিনের আলো, যেখানে স্মৃতির কুয়াশা কেটে গিয়ে ফুটে উঠেছে এক স্নিগ্ধ, মধুর সকাল।