প্রকৃতিকে ভালোবেসে
সোনালী রোজারিও,
গুজরাট

আমি সোনালী ঘুরে বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসি, অবশ্যই ভালোবাসার সূচনা আমার
স্বামীর হাত ধরেই। তিনি নিজে যেমন ঘুরতে ভালোবাসে তেমন আমাকে সাথে নিয়ে
ঘোরাতেও ভীষণ ভালোবাসে। গত ১৭ বছরে আমরা একসাথে আমাদের গাড়ি নিয়ে
প্রায় গোটা ভারতবর্ষে ঘুরে বেরিয়েছি। এক এক জায়গায় কতবার করে যে গেছি
তার হিসেবে নেই। ভারতবর্ষের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে বেড়িয়েছি
তবে কোথাও শপিং করে সময় নষ্ট করিনি আমরা।
বরাবর প্রকৃতি আমাদের টানে, আর আমরাও প্রকৃতির ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ
হয়ে বারবার প্রকৃতির বুকে ফিরে ফিরে যাই এবং নতুন ভাবে নতুন রূপে
তাদেরকে আবিষ্কার করি। তবে ঝোপ জঙ্গল জন্তু-জানোয়ার পশুপাখি ভালবাসি
বলেই যদি বাড়ির মধ্যেই একটা আস্ত অভয়ারণ্যের সৃষ্টি হয় তবে তো বাইরের
হাতছানি থেকে নিজেকে দূরে রাখতেই হয়। কাজের লোকের হাতে এসব কিছু ছেড়ে
দিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর নেশায় ঘুরতে যেতে পারি না। নিজে হাতে তাদের
পরিচর্যা করা, ভালোবাসা, সময় সময় তাদের জল খাত, খাবার ইত্যাদি দেওয়া,
এসব যেন এক অন্যরকম নেশায় পরিণত হয়েছে। গাছ গাছালি বোন অরণ্য জঙ্গল
পাহাড় নদী ঝর্ণা নানান রকম পাখি আর পশু পাখিদের সামনে থেকে দেখা তাদের
সাহচর্য পাওয়া এসব তো ছিলই এখন তার সাথে যোগ হয়েছে তাদের সেবা করার
নেশা। সকাল থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত কোথা থেকে যে সময় কেটে যায় বুঝতেই
পারি না। নানা দেশ বিদেশ থেকে নিয়ে আসা বিভিন্ন ধরনের গাছপালা বিভিন্ন
রকমের মাছ কচ্ছপ আর নানান প্রজাতির পাখির মেলা আমার বাড়িতে। যখন আমি
বাগানে ঢুকি গাছের পরিচর্যা করার জন্য, তখন প্রতিটা গাছের গায়ে
স্নেহপূর্বক হাত বুলিয়ে আমি তাদের সঙ্গে আমার ভাবের আদান-প্রদান করি।
আমি বুঝি আমার স্পর্শ ওরাও খুব ভালোবাসে।
আবার যখন পাখি দের কাছে আসি তারা তখন আমাকে যে কিভাবে আদর করে তা আপনাদের
বোঝাতে পারবো না। রাত্রি ঠিক ১১ টা বাজে আমার একুরিয়ামের মাছগুলোও যেন
আমায় ডাক দেয়। তাদের খাবার সময় হয়েছে সেটা যেন একুরিয়ামের দেয়ালের
কাছে এসে ঠোঁট নেড়ে আমায় ডাকে বলে- সময় তো হল, কই আমাদের খাবার দাও ।

এইসব অবলা জীব গুলোর চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি। বাড়িতে রাখা প্রতিটা
গাছপালার একটা একটা পাতার শিহরণ যেন আমার খুব চেনা খুব কাছের। আমি খুব
সহজেই বুঝে যাই ওরা কখন ক্লান্ত, কখন ওদের মন প্রসন্ন, কখন ওরা খাবার
চায়, কখনো ওদের পুষ্টির অভাব হয়, আবার কখন ওরা আমার থেকে স্নেহের পরশ
চায়।
সকাল থেকে রাত অবধি ওদের জন্য চিন্তা করেই কাটে আমার। তার ফাঁকে অবশ্যই
মেয়ের পড়া ও একটু দেখাতে হয়। স্বামী ডিউটি থেকে বাড়িতে ফিরলে তাঁকেও
একটু সময় দেওয়ার দরকার হয়, আবার সংসারের টুকিটাকি কাজ, রান্নাবান্না
সব তো আছেই।
এক এক পাখির এক এক রকমের খাবার। কেউ সূর্যমুখীর বীজ খায় তো কেউ আবার
কাংলী দানা খায়। কেউ আবার ড্রাই ফ্রুটস্ খায়, কারো আম পছন্দ, কারোর
পেয়ারা পছন্দ, কারোর কমলালেবু পছন্দ তো আবার কেউ আপেল পছন্দ করে। কলা
কোনটাও খেতে চায় না।
সব কাজ করতে করতে যখন একটু ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা টা এলিয়ে দিই, জিমিন
দৌড়ে আসে, আমাকে আদরে আদরে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। ওর ধারালো নখগুলো কখন
যে আমার পিঠে কাঁধে বসে যায় সে বোধহয় ও নিজেও টের পায় না। ওর ভাষায়
কত কি যে আমাকে বলে বকবক করে আমার ক্লান্তি এমনিই দূর হয়ে যায়। এখন
আবার সঙ্গে আর দুটো যোগাড় হয়েছে। গতকালকেই এসেছে ওরা। দুধের মত ধপ ধাপে
সাদা একজোড়া কাকাতুয়া। ওদের নাম রেখেছি ফ্রস্ট আর স্নো। ওদেরকে দেখে
জিমিনের উৎপাত কিছুটা বেড়ে গেছে। এতদিন একাই আমার বাড়িতে খোলা ঘুরে
বেড়াতো আমার পায়ে পায়ে, জিতুর কাঁধে মাথায় আর বাকিরা থাকে জাল দিয়ে
ঘেরা আলাদা আলাদা বারান্দায়। আমার ২৪০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটার
তিনদিকের বারান্দা বেলকনি ট্যারিস সবটাই এখন ওদের দখলে। আগে অবসরে
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা কফিতে চুমুক লাগাতে লাগাতে সামনের পার্কের
গাছ-গাছালি দেখতাম, বর্ষাকালে বৃষ্টির দিনে পাতার নাচন দেখতাম। এখন
সেসবের সুযোগ বড় একটা পাইনা। তবে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে মনটা এক
অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে ওঠে।

মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠি এত কাজ একা করতে পারি না। মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে,
ভীষণ রাগ হয় জিতুর ওপরে। নিজে তো এসব কিছু যোগাড় করেই খালাস, এদের
সবকিছুর পরিচর্যা সবকিছুই আমাকে দেখতে হয়। আবার ভাবি ও বেচারা কি করে
করবে? সারাদিনই ব্যস্ত থাকে নিজের ডিউটি নিয়ে। সকালে বেরিয়ে সেই রাত্রে
বাড়ি ফেরে, তবে ছুটির দিনে অবশ্যই ও আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাকে
সাহায্য করে।
মেয়েটা আবার আমার উল্টো। আমরা দুজনেই এত প্রকৃতি ভালোবাসি, পশুপ্রেমিক
কিন্তু ও ভীষণ ভয় পায়। আমাদের সাথে ঘুরতে যায়, ঘুরতেও ভালইবাসে।
কিন্তু পশু পাখি থেকে একটু দূরেই থাকে। তার উপরে ওর পড়ার চাপও অনেক
বেশি, ওর কাছে বিশেষ সময়ও নেই।
গুজরাটে প্রচন্ড গরম পড়ে, এই গরমে গাছপালা পশু পাখি মাছ সবাইয়ের বিশেষ
খেয়াল রাখতে হয়। মাছের জলের টেম্পারেচার চেক করতে হয় খুব ঘন ঘন। জলের
তাপমাত্রা ২৬° থেকে ২৮ ডিগ্রীর মধ্যেই রাখতে হয়। তাপমাত্রা ২৬° থেকে কম
হলে বা ২৮°c থেকে বেশি হলে সব মাছ মরে যাবে, তাই জলের তাপমাত্রা কমে গেলে
হিটার লাগাতে হয় আবার তাপমাত্রা বেড়ে গেলে হিটার বন্ধ করে জলকে নরমাল
টেম্পারেচারে নিয়ে আসতে হয়। খুব ঘন ঘন জল চেঞ্জ করাও যায় না, জলের
পিএইচ লেভেল কমে যায়। খেয়াল রাখতে হয় জলে অক্সিজেনের পরিমাণ ঠিক আছে
কি না। আরো নানান সাত সতেরো খেয়াল রাখতে হয়। পাখিদের সমস্ত খাবার
জায়গা জলের জায়গা প্রতিদিন মেজে ধুয়ে ঝকঝকে চকচকে পরিষ্কার করে রাখতে
হয়, প্রতিদিন ফ্রেশ খাবার দিতে হয় নইলে ওদের ডায়রিয়া হয়ে যাবে। আর
ওরা অসুস্থ হলে- অবলা জীব ওরা মুখে বলতে পারবে না কিন্তু ভীষণ কষ্ট পাবে
আর সে আমি সহ্য করতে পারবো না।

গাছগুলো আমার দিকে তাকিয়ে থাকে কখন তাদের সার দিতে হবে, কখন জল দিতে
হবে, কখন তাদের শুকনোপাতা সরিয়ে গা পরিষ্কার করে দিতে হবে, সবটাই আমাকে
করতে হয়। ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যাই আমি। কিন্তু যখন ওই গাছে নতুন কোন পাতা
গজায়, কুঁড়ি আসে ফুল ফোটে ফল ধরে তখন মনের ভিতর এক নৈসর্গিক আনন্দের
স্রোত বইতে থাকে। সারাদিনের পাখির কিচিরমিচিরে এক এক সময় কানটা যেন
ঝালাপালা হয়ে যায় কিন্তু আবার যখন ওইসব পাখিরা নতুন নতুন ডিম পাড়ে আর
সেই ডিম ফুটে ছোট্ট ছোট্ পক্ষী শাবক বেরিয়ে আসে তখন মনটা খুশিতে মেতে
ওঠে। রঙিন মাছ চিংড়ি আর কচ্ছপ দের ধরাধরি ছুটাছুটি লুকোচুরি খেলা দেখে
দেখে মনে পুলক জাগে। জিমিনের দুষ্টুমি দেখে দেখে হেসে বাচিনা আর। যখন
মেয়ের বন্ধুরা বাড়িতে আসে আর মেয়ের রুমে বসে ওরা সবাই আড্ডা দেয়, তখন
দরজার ফাঁক থেকে মাথা গলিয়ে জীমিন ওদের হাসাহাসির শব্দ অনুকরণ করে আমাকে
শোনায়। যেন বলতে চায়- মা ওরা ঘরের ভিতরে সবাই এই ভাবেই হাসাহাসি করছে।
তবে কখনোই জিমিন ওদের রুমের ভেতরে ঢুকে যায় না, প্রাইভেসি জিনিসটা ও
বোঝে। আবার এ ও বঝে, ওর দিদির সাথে বাইরের কয়েকজন আছে তার মানে দিদিকে
চোখে চোখে রাখতে হবে, তাই সিকিউরিটি গার্ডের মতো দরজার বাইরে থেকে মাথাটা
ভেতরে ঢুকিয়ে ১৮০° ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চোখ বড় বড় করে দেখে ওরা কি করছে।
আবার মাঝে মাঝে আমার কাছে উড়ে এসে বা দৌড়ে এসে আমাকে জানায় ওরা কিভাবে
শব্দ করে হাসছে। ও জানে বাবার চেয়ার কোনটা, বাবা সোফায় কোন জায়গায়
বসে। ও ঠিক তার পাশেই বসে থাকবে, কখন বাবা এসে বসবে আর ওকে একটু আদর
করবে। সকাল বেলা জিতু যখন ডিউটি বেরিয়ে যায়, ওর বাবা আমাকে বাই বলে
যায়। আজকাল জিমিন ওই 'বাই' শব্দটা খুব চিনতে শিখেছে। ও বুঝে যায় এবার
বাবা অনেকক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকবে। জিতু বেরিয়ে যাওয়ার পরও প্রায়
আধঘন্টা মেন দরজার সামনে ও অপেক্ষা করে আর অনেকক্ষণ নিজের ভাষায় কি যেন
বকবক করে। তখন ওর যত পছন্দের খাবারই দেওয়া হোক না কেন ও কিছুই মুখে নেবে
না।
আগে আমরা বেড়াতে গেলে আমাদের গাড়িতে সামনে বসে জিতু ড্রাইভ করতো, আমি
বসে থাকতাম পাশে আর পিছনের সিটে মেয়ে শুয়ে বসে ঘুমিয়ে আরাম করে
বেড়াতে যেতাম। কিন্তু এখন ড্রাইভারের সিট জিতুর জন্য বাঁধা, আমার শিট
জিতুর পাশে বাঁধা। কিন্তু মেয়ের হয়েছে যত জ্বালা। সে কোথায় বসবে,
কোথায় শোবে, আরাম করবে বুঝতেই পারে না। জিমিন আর অন্যান্য সবাইকে সাথে
নিয়ে বের হতে হয়। এখন ধীরে ধীরে পরিবার অনেক বড় হচ্ছে জানিনা এখন বছরে
কবার আমরা বাইরে বেড়াতে যেতে পারবো। তবে বাড়িটাই আমরা মিনি ফরেস্ট
বানিয়ে ফেলেছি এই যা শান্তি। শহরের যান্ত্রিক জীবন, বন্ধুবান্ধব
পাড়া-প্রতিবেশীদের পি এন পি সি থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছি
আমরা।
