নকশী কাঁথার ফসিল ও তার ভাঙন

রীতা বিশ্বাস পান্ডে,

নিউ-দিল্লি

ভোর তখনও স্পষ্ট হয়নি। পুবের আকাশে হালকা লালিমা ফুটছে মাত্র। মাটির ছোট্ট ঘরটায় টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেনের আলো। আর সেই আলোয় বাঁশের চাটাইয়ে বসে নিবিষ্ট মনে সেলাই করছে শিউলি। নকশী কাঁথার প্রতিটি ফোঁড় যেন তার জীবনের একেকটি অধ্যায়, একেকটি চাপা দীর্ঘশ্বাস। কালকে হাটে নিয়ে যাবে, বিক্রি করতে পারলে মেয়ের স্কুলের বেতনটা দেওয়া যাবে।

বাইরে তখন আশ্বিনের আমেজ। ছোট মেয়ে সম্পা মায়ের পাশে ঘুমিয়ে আছে, শান্ত, নির্বিকার। শিউলির মন জুড়ে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা। তার স্বামী, সুরেন্দ্র , গত তিন বছর ধরে শিউলিকে ছেড়ে উধাও। সে কি বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, কেউ জানে না। গ্রামের মানুষ প্রথমদিকে সহানুভূতির চোখে দেখলেও, এখন তার দিকে বাঁকা চোখেই তাকায়। একজন বিবাহিত নারী, যার স্বামী নেই, তার চলাফেরা, তার বেঁচে থাকা—সবকিছুই যেন সমাজের কাছে এক অস্পষ্ট প্রশ্নচিহ্ন।

হঠাৎ দরজায় মৃদু কড়া নাড়ার শব্দ। শিউলি চমকে ওঠে। এত ভোরে কে?

ভয়ে ভয়ে দরজা খুলতেই দেখে প্রতিবেশী নুসরাত আপা দাঁড়িয়ে। তার চোখে সহানুভূতি আর উদ্বেগ।

"শিউলি, কী করছিস এত ভোরে? ঘুমাসনি?" নুসরাত আপা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেন।

শিউলি হারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। "কাঁথা সেলাই করছিলাম আপা। কালকে হাটে নিয়ে যেতে হবে। সম্পার স্কুলের বেতনটা বাকি পড়েছে।"

নুসরাত আপা ভেতরে এসে বসেন। তার মুখ গম্ভীর। "জানিস, মোড়লের ছেলেটা কালকে আবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল।"

শিউলি শরীরটা শক্ত করে। "কী বলছিল আপা?"

"বলছিল, তুই নাকি একলা থাকতে পারিস না। সমাজের নিয়ম ভাঙছিস। আর তোর নাকি একটা গতি হওয়া দরকার।" নুসরাত আপা ইতস্তত করেন।

শিউলি ফোঁড় থামিয়ে দেয়। তার হাতে ধরা সূঁচটা কেঁপে ওঠে। "গতি মানে? আমি তো কাজ করে খাচ্ছি। কারো কাছে তো হাত পাতিনি!"

"সেটা তো আমিও জানি," নুসরাত আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। "কিন্তু এ সমাজ তোকে সহজভাবে মেনে নেবে না। একটা পুরুষের ছায়া না থাকলে নারীর কোনো আশ্রয় নেই, শিউলি। এ সমাজের অলিখিত নিয়ম।"

শিউলি নিষ্পলক চোখে নকশী কাঁথাটার দিকে তাকায়। কত সুতো, কত স্বপ্ন জড়িয়ে আছে এই কাঁথায়। কিন্তু এই সমাজ যেন সেই স্বপ্নগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে চায়।

আজ হাটে বেশ ভিড়। শিউলি তার নকশী কাঁথাগুলো নিয়ে এক কোণে বসে আছে। আশেপাশের পুরুষেরা তাকে দেখছে, কেউ সরাসরি, কেউ আড়চোখে। তাদের চোখে প্রশ্ন, কৌতূহল, আর কখনো কখনো লালসা। দু'একজন ক্রেতা আসে, দাম জিজ্ঞেস করে চলে যায়।

"এই যে মেয়ে," একজন মাঝবয়সী লোক এসে দাঁড়ায়। তার চোখে দুষ্টুমি ভরা হাসি। "কতো করে দিবি এই কাঁথা? নাকি শুধু কাঁথাই বেচিস, আর কিছু?"

শিউলি অসহায় অনুভব করে। তার মুখের রক্ত শুকিয়ে যায়। সে জবাব দেয় না, শুধু কাঁথাগুলো গুছিয়ে নেয়।

পাশের দোকান থেকে ফজল মিয়া, গ্রামের একজন প্রবীণ ব্যক্তি, এই দৃশ্য দেখছিলেন। তিনি দ্রুত এগিয়ে আসেন।

"কী হচ্ছে এখানে?" ফজল মিয়া কঠোর গলায় বলেন। "একজন অসহায় নারীকে কেন তোমরা এভাবে বিরক্ত করছ? তোমাদের ঘরে মা-বোন নেই?"

লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে সরে যায়।

ফজল মিয়া শিউলির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলেন, "মন খারাপ করিস না মা। এই সমাজটাই এমন। এরা শক্তিমানকে ভয় পায়, আর দুর্বলকে সুযোগ পেলেই দাবিয়ে রাখতে চায়।"

শিউলি মৃদুস্বরে বলে, "আমি কি দুর্বল ফজল চাচা? আমি তো দিনরাত পরিশ্রম করছি আমার মেয়ের জন্য। সুরেন্দ্র নেই, তাতে কী? আমি তো এখনো মরে যাইনি!"

"সেটা তো তোর আত্মবিশ্বাস," ফজল মিয়া বলেন। "কিন্তু সমাজের চোখে তোর কপালে একটা অদৃশ্য দাগ এঁটে গেছে। 'স্বামী পরিত্যক্তা', 'একলা নারী'—এইসব শব্দগুলো কাঁটার মতো বিঁধবে তোকে।"

শিউলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই সমাজের চোখে সে কেবল একজন নারী, যার একজন পুরুষ অভিভাবক নেই। তার পরিশ্রম, তার সংগ্রাম, তার আত্মমর্যাদা—সবই যেন অদৃশ্য এক দেয়ালের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়।

দেবীপক্ষ শুরু হয়েছে। গ্রামের মণ্ডপে প্রতিমার চোখ আঁকা হচ্ছে। ঢাকের শব্দে বাতাস ভারি। শিউলি তার ছোট্ট মেয়ে সম্পাকে নিয়ে মণ্ডপে আসে। সম্পা মুগ্ধ চোখে প্রতিমার দিকে তাকিয়ে আছে।

"মা," সম্পা জিজ্ঞেস করে, "মা দুর্গা কী খুব শক্তিশালী?"

"হ্যাঁ রে সোনা," শিউলি সম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। "মা দুর্গা অন্যায়কে বিনাশ করেন। তিনি নারীশক্তির প্রতীক।"

এই সময় মোড়লের ছেলে মণ্ডপে আসে। তার চোখে শিউলিকে দেখে এক হাসি ফুটে ওঠে। সে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে কী যেন ফিসফিস করে হাসে।

শিউলি সব দেখে, সব বোঝে। তার ভেতরের অভিমান আর রাগটা যেন একত্রিত হয়ে একটি শক্ত পাথরে পরিণত হয়। সে আর চুপ করে থাকতে পারে না।

"মোড়লের ছেলে!" শিউলি উচ্চস্বরে ডাক দেয়। তার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল, যা শুনে মণ্ডপের লোকজনের মনোযোগ তার দিকে ঘুরে যায়।

মোড়লের ছেলে প্রথমে থতমত খেয়ে যায়। "কী রে ডাইনি! এত সাহস তোর? মণ্ডপে এসে গলা চড়াচ্ছিস?"

"ডাইনি?" শিউলি হাসে, সে হাসি ব্যঙ্গের, প্রতিবাদের। "তোমরা আমাকে ডাইনি বলো? আমি তো তোমাদের মতো রাতের আঁধারে অন্যের উপর কুদৃষ্টি দিই না। আমি তো তোমাদের মতো দিনের আলোয় নারীকে অপমান করি না!"

মণ্ডপে নীরবতা নেমে আসে। সবাই হতবাক।

"আমার স্বামী নেই, তাই বলে কি আমি মরে গেছি?" শিউলি আরও জোরালো গলায় বলে। "আমার স্বামীর অনুপস্থিতি আমার দুর্বলতা নয়, আমার শক্তি। আমি একা হাতে এই মেয়েকে মানুষ করছি। আমি দিনরাত পরিশ্রম করে নিজের অন্ন জোগাচ্ছি। আমি সমাজের কোনো বোঝা নই!"

সে মোড়লের ছেলের দিকে সরাসরি তাকায়। "তোমরা ভাবো, নারী মানেই দুর্বল। পুরুষ না থাকলে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মা দুর্গা তো একা। তিনি একাই মহিষাসুরকে বধ করেছেন। আমাদের ভেতরের শক্তিকে তোমরা চিনতে পারোনি। আমার মতো কত শিউলি আছে এই গ্রামে, যারা নীরবে তোমাদের লাঞ্ছনা সয়ে যায়! আজ থেকে আর নয়। এই দেবীপক্ষ আমার ভেতরের দেবীশক্তিকে জাগিয়ে দিয়েছে। আমি কারো দয়া চাই না, চাই আমার অধিকার, আমার সম্মান।"

তার কথা শুনে গ্রামের মহিলারা একে একে এগিয়ে আসে। নুসরাত আপা, সুরবালা ঠাকুমা—সবাই শিউলির পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের চোখেও এক নতুন আলো, এক অদম্য সাহস। মোড়লের ছেলে আর তার বন্ধুরা মাথা নিচু করে মণ্ডপ ছেড়ে চলে যায়।

দিন যায়। আবার দেবীপক্ষ আসে।শিউলির সেলাই করা কাঁথাগুলো হাটে এখন সম্মান পায়। গ্রামবাসী, বিশেষত মহিলারা, শিউলির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। তারা বোঝে, শিউলি একা নয়, সে তাদেরই একজন, যে অন্যায়কে মেনে নেয়নি। গ্রামের কিছু শিক্ষিত যুবক, অয়নের মতো, শিউলির পাশে দাঁড়ায়, তাকে আইনি পরামর্শ দেয়।

শিউলি জানতে পারে, সুরেন্দ্র বেঁচে নেই। তার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়। শিউলিকে তার স্বামীর রেখে যাওয়া কিছু সামান্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সমাজের কাছে তার 'স্বামী পরিত্যক্তা' পরিচয়ের বদলে 'বিধবা' পরিচয়টি বেশি সম্মানজনক হয়ে ওঠে। যদিও সমাজের এই দ্বিচারিতা তাকে ব্যথিত করে, তবুও সে বোঝে, এইটুকুই আপাতত তার জন্য এক বিজয়।

যখন বিজয়া দশমীর প্রতিমা বিসর্জন হচ্ছিল, শিউলি সম্পাকে নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে একটি নতুন নকশী কাঁথা। তাতে কোনো পুরনো দুঃখের ফোঁড় নেই, আছে নতুন জীবনের উজ্জ্বল রঙ।

সম্পা মায়ের হাত ধরে বলে, "মা, মা দুর্গা চলে যাচ্ছেন?"

শিউলি হাসে, সে হাসি আজ সম্পূর্ণ নিজের, কোনো আরোপিত হাসি নয়। "না রে সোনা, মা কোথাও যান না। মা আমাদের ভেতরেই থাকেন। দেবীপক্ষ কেবল উৎসব নয়, এই সময়েই আমাদের নিজেদের ভেতরের শক্তিকে নতুন করে চিনতে হয়। সমাজের যে ফসিলগুলো আমাদের দাবিয়ে রাখতে চায়, তাদের ভাঙতে হয়। আর সেই ভাঙনের উপরই তৈরি হয় নতুন জীবনের নকশা।"

শিউলি জানে, তার পথ এখনও দীর্ঘ। কিন্তু তার ভেতরের শক্তি, তার আত্মমর্যাদা তাকে পথ দেখাবে। কুসংস্কার, বৈষম্য আর পুরুষের আধিপত্যের যে অদৃশ্য দেয়াল, তা ভাঙতে হয়তো আরও অনেক শিউলির প্রয়োজন হবে। কিন্তু আজ এই দেবীপক্ষের দিনে, শিউলি যেন নিজেই এক জীবন্ত দেবী, এক নীরব প্রতিবাদের নকশী কাঁথা, যা সমাজের বুকে নতুন ইতিহাস বুনে চলেছে।

~ক্রমশ~