মোহময়ী মধ্যপ্রদেশ (বান্ধবগড়) দ্বিতীয় পর্ব
মৈত্রেয়ী ব্যানার্জী,
বালি হাওড়া
পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য
লাইব্রেরি
বিভাগে দেখুন...
MP TOURISM HOTELS AND RESORTS এ ঘর বুক করা ছিল চারমাস আগেই। শিপ্রা
এক্সপ্রেসে ঘিনঘিনে সময় কাটিয়ে যখন কাটনি মারওয়া স্টেশনে পা রাখলাম
তখন রোদের তেজ বেড়েছে। RESORTS থেকে গাড়ি পাঠিয়েছে। স্টেশনটি ভিড়ে
থিকথিক করছে। নানা রঙের উজ্জ্বল সিন্থেটিক শাড়ি পরিহিত মহিলারা স্টেশনের
মেঝে আলো করে বসে আছেন ট্রেনের অপেক্ষায়। চারপাশে নোংরা আবর্জনা। যে
ট্রেন থেকে আমরা নামলাম তার বাথরুম থেকে ফোর্সে জল বেরিয়ে স্টেশন
প্লাবিত করছে। এককথায় স্বর্গীয় অনুভূতি বললে অত্যুক্তি হবে না। যাই হোক
এসব কাটিয়ে বেরিয়ে এসে সারথি কৃষ্ণকুমারের গাড়িতে উঠে বসলাম।
স্টেশন সংলগ্ন রাস্তা যথেষ্ট খারাপ। তবে একটু পরেই শুরু হল হেমা মালিনীর
গালের মত মসৃণ রাস্তা। যে উপমাটি ব্যবহার করলাম সেটি এক বিশিষ্ট
রাজনীতিবিদের সবাই জানেন। সারথি কৃষ্ণকুমার শুধু দুবার আমাদের পথের সঙ্গী
হয়েছে। একবার রিসর্টে পৌঁছে দেওয়া এবং একবার রিসর্ট থেকে কাটনি জংশনে
পৌঁছে দেওয়া। কৃষ্ণ এখানকার ভূমিপুত্র। বান্ধবগড় কোর এরিয়াতে থাকতো
একসময়, এখন রিলোকেটেড হয়ে পাশেই একটি গ্রামে থাকে। পরে শুনলাম এরকম বেশ
কিছু আদিবাসী মানুষ তাদের গ্রাম ছেড়ে দিয়ে পাশে সরে গেছেন শুধুমাত্র একটি
জঙ্গলকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। ধন্য তারা। যেখানে গাছ কেটে সাফ করে দেওয়া
হচ্ছে, সেখানে একটি জঙ্গল ও জংলী প্রাণী বাঁচাতে নিজের ভিটে ছেড়ে চলে
যাওয়া কতবড় ত্যাগ সেটা আর বিশদে না বোঝালেও চলবে।
যেহেতু আমাদের কাটনি পৌঁছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেছিল তাই আমরা রাস্তায় একটি
ধাবাতে সেউ টমাটর দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে তবে রিসর্টে প্রবেশ করলাম।
রিসর্টে ঢোকার আগে থেকেই যখন জঙ্গলের বাফার জোনের মধ্যে দিয়ে আসছিলাম
তখনই একটা আলাদা অনুভূতি হচ্ছিল। কৃষ্ণ বলল মাঝে মাঝে বাঘ বাফার জোনে এসে
পড়ে। হাতির দলের দেখাও মিলতে পারে। তবে বাঘ নাকি ভয়ংকর নয় ততটা, যতটা
হাতির দল। তাই সবসময় জঙ্গলে যেন হাতির সামনে পড়তে না হয়, এই ভাবনা
মাথায় রাখতে হয়। আমি অত বুঝি না। ওর কথার মাঝে আমার মনে হচ্ছিল, হাতি,
বাঘ যে আসে আসুক না, একটু প্রাণভরে দেখি। নাহ। এরা কেউ আসেনি। এসেছে
অসংখ্য হরিণের পাল। তা দেখেও কম আনন্দ পাইনি। যখন রিসর্টের বিরাট গেটের
অন্দরে প্রবেশ করলাম তখনও মনে হল বাফার জোনেই আছি, শুধু একটু সাজানো
গোছানো, এই যা। প্রবেশদ্বারের পাশেই বিশাল বৃক্ষে মুখপোড়া হনুমানের দলবল
আমাদের আমন্ত্রণ জানাল।
গাড়ি থেকে নামতেই রিসর্টের অফিস থেকে একজন এসে ওয়েলকাম জানিয়ে কপালে
মঙ্গলটিকা পরিয়ে ওয়েলকাম ড্রিংক দিয়ে আহ্বান জানালেন। ড্রিংক অর্থাৎ
সরবতে চুমুক দিয়ে মনটা গার্ডেন গার্ডেন হয়ে গেল। সরবত শেষ করে, অফিসিয়াল
কিছু জিনিস সাঙ্গ করে রিসেপশন পেরিয়ে Attendant নিয়ে গেল ব্রিজের মতো
রাস্তা ধরে একটা কেবিনে। গোটা এলাকা জুড়ে এরকম প্রচুর কেবিন রয়েছে।
আমাদের কটেজগুলো ব্রিজের উপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। আবার তিরতিরে নদীর
পাশে বারান্দা সমেত কেবিনও আছে। চারপাশে বিশাল বিশাল বৃক্ষ দিয়ে ছাওয়া
মনোরম পরিবেশ। কোথাও কোন আওয়াজ নেই, একমাত্র পাখির ডাক ছাড়া। বড় বড়
গাছের তলায় আছে দোলনা, স্লিপ, বাচ্চাদের খেলার নানা উপকরণ। যদিও সব ঘর
ভর্তি হয়ে গেছে পর্যটকে, কিন্তু সবাই বয়স্ক অথবা কমবয়সী স্বামী স্ত্রী।
বাচ্চা একটিও নেই। সুতরাং জঙ্গলের দোলনা বয়স্কদের দখলে।
রিসর্টের নিজস্ব সম্পত্তির মত তিরতিরে ঝিরঝিরে কাচের মত নদীটি একতলা সমান
নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। তারপরই ঘন জঙ্গল শুরু। শুধু নদীর বয়ে যাওয়া,
জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বাতাসের আওয়াজ আর পাখির ডাক এই নিয়ে বসে থেকে ঘন্টার
পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। নদীর ধারে আসার পথে রিসর্টের আরও তিনটি
সুন্দর জায়গা আছে। একটি টলটলে সুইমিং পুল। একটি স্থানে ক্যাম্প ফায়ারের
ব্যবস্থা আছে। আর আছে একটি গাছে গাছে ছাওয়া প্রশস্ত জায়গা। সেখানে অনেক
চেয়ার দিয়ে সাজানো। দুপুরে বুঝতে পারিনি এই জায়গাটা কিসের জন্য। বিকেলে
বুঝতে পারলাম। ওখানে হাই টি পরিবেশিত হয়। সকল পর্যটক ওখানে জড়ো হলে একটি
টি স্টলে এলাচ দুধ চিনি সহযোগে চা, গরম গরম মুচমুচে পকোড়া পরিবেশিত হয়।
তার সঙ্গে সামনে একটা বিরাট স্ক্রিনে চলে ডকুমেন্টারি ফিল্ম। সবই
বান্ধবগড়, কান্হা, কুনো ও পান্নার ওপর। আর একজন আঞ্চলিক মানুষ অদ্ভুত
সুরে বাঁশি বাজিয়ে গোটা রিসর্টে ঘুরে বেড়ান। তাঁর গায়ে বাঘের মত পোশাক
আর মাথায় ফুলের টুপি। যেন গোটা একটা অরণ্যের প্রতিভূ ওই ব্যক্তি। আর চলে
বিভিন্ন প্রদেশ এবং দেশ থেকে আগত মানুষের মধ্যে আলাপ আলোচনা ।
চায়ের আসরের নাম 'পনঘট'। এই পনঘটে বসে চা আর পকোড়া খেতে খেতে ঘন
অন্ধকার নেমে এলে যখন আপনি মাথার উপরে তাকাবেন, দেখবেন, কালো চাঁদোয়ার
ওপরে অসংখ্য সলমা চুমকির জরির কাজের মত নক্ষত্রপুঞ্জ জ্বলজ্বল করছে।
শহরের কলুষতা মুক্ত এক আকাশ পৃথিবী যেন হাতের মুঠোয়।
বান্ধবগড় বহু পুরোনো একটি জনপদ। শোনা যায় ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র আপন
ভ্রাতা লক্ষণকে এই কেল্লা উপহার দিয়েছিলেন। চতুর্দশ (মতান্তরে দ্বাদশ)
শতাব্দীতে বান্ধবগড় চলে আসে বাঘেল শাসকদের হাতে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে
অবস্থিত এই স্থানে যাতায়াত ব্যবস্থা দুরূহ ছিল। তাই কয়েক শতাব্দী পরে
১৬১৭ সালে রাজা বিক্রমাদিত্য সিং নিজের রাজধানী বান্ধবগড়ের ১২০ কিমি
উত্তরে অবস্থিত রেওয়ায় স্থানান্তরিত করেন। তখন এই অঞ্চল জনশূন্য হয়ে
ঘন জঙ্গলে পরিবৃত হয়ে যায় ও জঙ্গলের রাজা রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের
রাজত্ব কায়েম হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ বান্ধবগড় হয়ে উঠেছিল বাঘেল শাসকদের
মৃগয়াভূমি, তাই বাঘের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে।
পরবর্তী কালে ব্রিটিশ আমলেও অত্যাধিক শিকারের ফলে বান্ধবগড় একসময়
প্রায় ব্যাঘ্রশূন্য হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরে ভারত সরকারের বনবিভাগের
ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। এর প্রথম
পদক্ষেপ হিসাবে বান্ধবগড়কে জাতীয় উদ্যান বলে ঘোষণা করা হয় ১৯৬৮ সালে।
১৯৭২ সালে Wildlife Protection Act পার্লামেন্টে পাশ করা হয়। ১৯৭৩ সালে
প্রোজেক্ট টাইগার চালু করা হয় বাঘ সংরক্ষণের জন্য। বান্ধবগড়ের বাঘের
সংখ্যা এরপর বাড়তে থাকে। ১৯৭৩ সালে যেটি মাত্র ১০৫ বর্গকিমি ছিল আজ
বেড়ে কোর এরিয়া হয়েছে ৭১৬ বর্গ কিলোমিটার। ১৯৯৩ সালে বান্ধবগড়কে
টাইগার রিজার্ভ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এর পরেই আশেপাশের গ্রামকে
অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রামবাসীরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি
সহযোগিতা করে। যার জন্য জঙ্গলের পরিধি বাড়ে ও বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
গ্রামবাসীদের এই ত্যাগের প্রতিদানে অনেককেই এই টাইগার রিজার্ভে জীবিকা
নির্বাহের ব্যবস্থা করা হয়।
পরদিন একদম ভোরের জঙ্গল সাফারি আমরা বুক করেছিলাম। তাই সান্ধ্য চায়ের
আসর শেষ হবার কিছু পরেই রাতের ডিনার পর্ব সেরে নেওয়া হল। এখানে যদিও
খরচটা একটু বেশিই, কিন্তু সমস্ত খাওয়া দাওয়া complementary থাকার জন্য
খরচটা খুব একটা বেশি মনে হয় না। সমস্ত ব্যবস্থাই neat and clean ।
খাবারের মান ভীষণই ভাল। বুফে সিস্টেমে। সুন্দর ডিনারের পর রিশেপসানের
ভদ্রলোক প্রত্যেকের থেকে আলাদা করে পরের দিন সকালের প্রাতরাশে কে কি খাবে
জেনে নোট করে নিলেন। কারণ ভোর পৌনে ছটায় রিপোর্টিং টাইম। তখন চা খেয়ে
সাফারি শুরু হবে। সঙ্গে প্রাতরাশের বাস্কেট ওনারা দিয়ে দেবেন।
ক্রমশ..............