কৃষ্ণময় মায়াপুর (দ্বিতীয় পর্ব)

অদিতি মন্ডল,

কলকাতা


পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য লাইব্রেরি বিভাগে দেখুন...


একটু বিশ্রাম নিয়ে যখন উঠলাম তখন কাঁচের জানালায় চোখে রেখে দেখলাম আকাশের গায়ে ছোপ ছোপ সন্ধ্যা নেমেছে। হোটেলের সামনের রাস্তার চিত্র ও বদলে গেছে। সন্ধ্যার আলো জ্বালা হাজার দোকান ভরেছে রাস্তার দুই ধার। অনেক তীর্থযাত্রীদের যাওয়া আসা লক্ষ্য করলাম। এরপর দেরি না করেও আমরাও রেডি হয়ে রওনা দিলাম শ্রী ভগবান আমার প্রাণনাথের দর্শনে এবং কৃষ্ণ নামের রসাস্বাদনে।

গদা ভবনের সামনের প্রাঙ্গন পেরিয়ে ডান দিকের দরজা দিয়ে ঢোকার মুখটাতে বেশ ভিড়। ভিতরে শুনতে পেলাম অবাঙালি কন্ঠে হরিনাম সংকীর্তন। ভিড় ঠেলে তিনজন এগিয়ে দেখতে পেলাম বিদেশিগনের ভবনের সামনে বিভিন্ন বিদেশী লোকেরা হরেক বাদ্যযন্ত্র সহকারে মাইক্রোফোনে হাত তুলে তুলে হরিনামে ও ভজনে মেতেছে। আর এদের সাথে এদেশীয় লোকেরাও দুহাত তুলে নামের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে এক সুরে গাঁথা হয়ে হরে কৃষ্ণ নামের মালা হয়ে যাচ্ছিল। আমরাও সেই রসে বঞ্চিত থাকি নি, কৃষ্ণ বলে দুহাত তুলে দুলে দুলে নেচে উঠেছিলাম।

সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। প্রধান মন্দিরের দিকে। এখানে এন্ট্রি গেটে পার্স জুতো মোবাইল ইত্যাদি বারণ, সেই মতো আমরা এই সব কিছু জমা করে টোকেন নিয়ে বিশাল পাথর বিছানো প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। লক্ষ্য করলাম এই প্রাঙ্গণের পাথরগুলি একটু খর খরে। এরপর লম্বা প্রশস্ত পাথরের সিড়ি দিয়ে ভেতরে ঢুকলে মন্দিরের বারান্দা। ইতিমধ্যেই বেশ ভিড় জমে গেছে। ভিতর থেকে খোল করতাল যোগে হরিনাম ও তার সাথে মাঝে মাঝে উলুধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ভিড় ঠেলে এগোতেই কয়েক ধাপ সিঁড়ি নিচের দিকে দেবতার মূর্তির সামনে একটি নিচু বড় প্রাঙ্গনে গিয়ে পড়ে। এখানে লোকজন শতরঞ্চি বিছিয়ে তার উপরে বসে আছে। পাথরের বাঁদিকে স্টিলের ইউ ম্যানেজারের ওপারে বৈষ্ণব দল একই সুরে ও তালে গেয়ে ও নেচে চলেছেন। তাদের সাদা পোশাক, তিলক কাটা কপাল, আর ভক্তি গদগদ চোখ দেখে আমাদের অন্তরে ও বেশ ভক্তির ভাব জাগছিল। আর সবাই এর মত আমরাও বসে দুহাত তুলে কৃষ্ণ নামে মেতে উঠলাম। তবে ঠাকুর মণ্ডপে আমার সুধাসাগর কৃষ্ণ কে দেখলাম না। দেখলাম গৌর নিতাই ও আরো অনেক প্রতিমা। সবগুলো প্রতিমা যে চিনলাম তা কিন্তু নয়।

যাক গে, এতক্ষণে সব ভালই চলছিল হঠাৎই সিকিউরিটি কড়া কন্ঠে চেঁচিয়ে সবাইকে উঠে দাঁড়াতে বলল। বয়স্ক মানুষদের উঠতে দেরি হওয়াতে আরো কর্কশ ভাবে তাদের উঠে যেতে বলল। ভক্তি ভাবের উপর কি নিয়ম কানুন চলে! তবে কি আর করা যায়.....

এবার দেখলাম সাদা পোশাকের বৈষ্ণব গন গান নাচ করে লাইন দিয়ে ডান দিকের প্রাঙ্গণে চলেছে। তাদের পিছু পিছু আমরা এবং বাকি সব ভক্ত মন্ডল হাজির হলাম সেই প্রাঙ্গণে। প্রচন্ড ভিড় অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে দর্শন পেলাম আমার প্রাণনাথের। প্রাণেশ্বর তার রাধারানী ও গোপিনীবৃন্দ পরিবেষ্টিত, অপরূপ নয়নাভিরাম দৃশ্য। তার অরূপ মহিমায় প্রেম রূপে অবতীর্ণ আমার প্রাণ সখা শ্রী কৃষ্ণ। বড় ঝাড়বাতির আলোর ছটাও যেন সেই রূপের কাছে ম্রিয়মাণ। তার রূপের মোহে মহিত আমার চোখের বারিধারা যেন বাগ মান ছিল না। এমন অসীম সুন্দর চিরসখা অনাথের নাথ, অবলার বোল নির্ধনের ধনের যেন রূপের শেষ নাই। এখানে প্রাঙ্গণে আরেক দল বৈষ্ণব গেরুয়া পোশাক পরে খোল কর্তাল সহযোগে হরিনাম সংকীর্তন করে চলেছেন। মূর্তির সামনে পুরোহিত তালে তালে নেচে নেচে পঞ্চ প্রদীপ হাতে ভগবানের সন্ধ্যা আরতি করে চলেছেন । অনেক মানুষজন প্যাঁকাটির ওপরে সলতে জড়িয়ে আরতি করার জন্য দলবদ্ধভাবে এগিয়ে চলেছিল। চারিদিকে ভক্তগণ তার নামে মেতে উঠেছিল। হরিনাম নিয়ে মাতামাতি করা এমন উন্মাদনাময় পরিবেশ ভক্ত সমাহার দেখে দেখে ভাবে বিহবল হয়ে পড়ছিলাম আমি। এমন রসাসিক্ত ভাবমূর্তি আমাকে অভিভূত করছিল, বারংবার শিহরিত করছিল।


এমন ভাবেই কি তবে ভক্ত -দেবতার আর দেবতা- ভক্তের হয়ে ওঠেন কেবলমাত্র ভক্তি আর সমর্পণের মধ্য দিয়ে! তার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়ে তাকে যে কি বলব আর কি বলবো না বুঝতে না পেরে কেবল অবলার মত অশ্রু ঝরিয়ে চলেছিলাম। আর ভিতর থেকে যেন আমার সব কথা আমি তাকে বলে দিয়েছি, সব ভাবা ভেবে নিয়েছি, সব দেখা দেখে নিয়েছি আর সব পাওয়া পেয়েছির আবর্তে ঘুরে যাচ্ছিলাম। এমন মধুময় ভক্তির ঘূর্ণাবর্তে চেতন অবচেতনের মাঝে লক্ষ্য করলাম আমি তিঁনি আবৃত হয়েছি। অসংখ্য আওয়াজের মাঝেও নিশ্চিদ্র শান্তি বিরাজ করছিল মনে মাথায় আর শরীরে। সে এক নৈসর্গিক আনন্দ। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এরকম স্বর্গীয় আনন্দ নেওয়ার পর আচল দিয়ে চোখের জল মুছে হাসিমুখে প্রাণনাথ কে প্রাণে বেঁধে উঠে গেলাম নিশ্চিন্তে।

পরের দিন আমরা সকাল সকাল তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম গদা ভবনের সামনে যে রাস্তাটা মন্দির পরিবেষ্টিত হয়ে রয়েছে সেই দিকেই যাত্রা করলাম। বেশ পথ! সুন্দর পিচ ফেলা রাস্তা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গাছ-গাছালি তে ঘেরা, সারিবদ্ধ আম জাম নারকেল সবেদা ইত্যাদি গাছ। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তায় ছিমছাম নিরিবিলি পরিবেশ কোন কোন বৈষ্ণব কে আবার দেখলাম হাতে জপের মালার থলি নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে চলেছেন।

পথে দেখলাম গোশালা, এর সাথে লাগুয়া দোকানে গরুর দুধের ঘি বিক্রি হচ্ছে, আর বিক্রি হচ্ছে লাড্ডু পেড়া বরফি ঘি দুধ দই ইত্যাদি। এরপর চোখে পড়লো নির্মীয়মান নৃসিংহ মূর্তির বিশাল মন্দির। অপূর্ব কার্যের নিশানরূপে গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে আত্মপ্রকাশ করছিল শিল্পীর হাত জাদুতে প্রাণ পাওয়া অপূর্ব কার্যশৈলীর অপরূপ মন্দিরটি বিশাল কক্ষ হরিনামের জায়গা ভক্তগণের স্থান বাগান ইত্যাদি নিয়ে সে এক অপরূপ স্থান এরপর দেখলাম প্রভুপাদের মন্দির কতকটা আটচালা ঘরের ছাচে বানানো গেরুয়া রঙের একটি বিশাল মন্দির সুন্দর সবুজের সমারোহে ঘেরা সেখানে প্রভুপাদজি স্মিত হাসিমুখে নিয়ে বসে ভক্তগণকে আশীর্বাদ করছেন ও যেন ভক্ত ও ভগবান কে আহবান করছেন এক হওয়ার উদ্দেশ্যে । নিষ্ঠার সাথে প্রণাম সেরে আমরা উঠে পড়লাম। এরপর আরো বেশ কিছু পথ নিরিবিলিতে সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এগিয়ে চললাম। মন্দিরের পাঁচিলের ভেতরেই গোবিন্দাস নামের রেস্টুরেন্টিতে এলাম আমরা। এখানে এসি ঘরে ছিমছাম টেবিল চেয়ার পরিবেষ্টিত পরিবেশ। খুব আড়ম্বর নেই তবে সেখানে কোয়ালিটি এবং স্যাটিসফ্যাকশন বর্তমান। মার্জিতো ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে গেল। প্রায় ১৫ মিনিট পরে এসে গেল গরম গরম পরোটা আর আলুর সবজি আর আচার কাঁচা লঙ্কা ও লস্যি। আয়েস করে বসে এই এতো বড় পরোটা বা ধোসা শেষ করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হল। ভালো স্বাদের গুণের ও ঠিকঠাক দামের খাবার খেতে হলে যেতেই হবে গোবিন্দাস-এ।

এরপর আমরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আরো বেশ কিছুটা পথ হেঁটে মন্দিরের এক নম্বর গেটে থেকে বেরিয়ে টোটো ধরে নিলাম, উদ্দেশ্য আজ নিমাই এর বাড়ি নবদ্বীপে যাওয়া। মনটা যেন খুশিতে টগবগ করছে। দুটো জায়গা ঘোরার সৌভাগ্য হবে ভাবিনি আগে। রাস্তায় যেতে যেতে শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় মঠ, গোপীনাথ মন্দির, জগন্নাথ মন্দির ইত্যাদি বিভিন্ন মন্দির দর্শন করতে করতে আমরা পৌছালাম। পথে শাক্ত বৈষ্ণব ও শৈব সংস্কৃতির সে এক অপূর্ব মিলন ক্ষেত্র। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এসে পড়লাম লঞ্চঘাটে। এখানে লঞ্চে দেখলাম বেশ ভালো, সময় কে মেনটেইন করে। মাত্র মিনিট দুয়েক জেটিতে দাঁড়ায় লঞ্চটি। যে কজন যাত্রী হবে সেই কজনকে নিয়েই লঞ্চ রওনা দেবে ওপারে। বেশ ঘন ঘন লঞ্চ। তাই খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয় না।


লঞ্চের চালক পেছনে থাকে তাই নদীতে লঞ্চটা একপাক ঘুরেই এগিয়ে চলল। জলঙ্গি নদীতে ঢেউ কেটে এগিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চ। নদীটা খুব একটা চওড়া নয়, একটু ঘোলা ঘোলা জলটা। নদীর দুপাশে লম্বা লম্বা ঝোপ জঙ্গলে সাদা সাদা কাশফুল গুলো বাতাসের ছন্দে ছন্দে ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছে আর যেন এক নিঃশব্দ সুর তুলে চলেছে বাতাসের কানে কানে। এরপর আরও একটু চলার পরে মনে হল নদীটা দু ভাগ হয়েছে। ডানদিকের শাখায় আমাদের লঞ্চটা ভেসে চলল।

শুনলাম এখানে দুটি শাখা নয় দুটি নদীর মিলন স্থল। যেন হালকা হেসে জলঙ্গি তার চপল চাহনি দিয়ে ভাগীরথীর বুকে শিহরণ তুলে একটু ছোঁয়ায় তার আশ্বাস বাড়িয়ে হাসতে হাসতে তার বুকে হিল্লোল তুলে ডান দিকে বাঁক নিয়ে আলাদা হল, অপূর্ব দৃশ্য।

একটু পরেই আমাদের লঞ্চটা দোলা লাগিয়ে জেটিতে গিয়ে থামল। লঞ্চ থেকে নেমে দুটি রাস্তা ভাগ হয়ে গেছে, একটি রাস্তা লোকজন এসে লঞ্চ ধরবে আর আর একটা কাঠের সাঁকো দিয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। বেরোনোর মুখে কেমন যেন কাজ করতে না চাওয়া ভাব এমন এক উষ্ক খুশ্কো চেহারার লোক আমাদের টিকিট চেক করছিল।

এরপর আমরা দাম-দর করে একটা টোটো রিজার্ভ করলাম। টোটো দাদা আমাদের নবদ্বীপ দর্শন এ নিয়ে চলল। টোটো দাদার নির্দেশ মতো আমরা আমাদের জুতো টোটো তে খুলে রেখে নেমে গেলাম পরপর মন্দির দর্শন করার জন্য। প্রথমেই টোটোটা এসে থামলো একটি মন্দিরের চাতাল এর সামনে। শ্বেত পাথরের চাতাল বেশ ঠান্ডা। চাতাল পেরিয়ে সিড়ি দিয়ে খানিকটা ওঠে মন্দিরের বারান্দা। এখানে রাধা কৃষ্ণের যুগল মূর্তি তাদের ভুবন ভুলানো রূপ নিয়ে দণ্ডায়মান। বাঁদিকের কোণে বসে আছেন বাল গোপাল। গোপালের পিছনে তার পালঙ্ক মশারি লাগানো। মন্দিরের চারিদিক থেকে রাস্তা আছে পরিক্রমা করার জন্য। আমি তিনবার হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ এই নাম মন্ত্র জপ করতে করতে পরিক্রমা করে নিলাম। সেই সময় বাবার সাথে বাবার পূর্ব পরিচিত কিছু মানুষজনদের দেখা হয়, বাবা তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেই ব্যস্ত হয়েছিলেন । এরপর আমরা টিকিট কেটে মন্দিরেরই আন্ডার গ্রাউন্ডে গেলাম গুপ্ত বৃন্দাবন ধাম ঘুরে আসার নিমিত্তে। এখানে একটি সরু গলির মত ছিল পরিক্রমা করার জন্য। আর তারই দেয়ালে কৃষ্ণ এবং শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাল্যলীলার বিভিন্ন মূর্তি প্রতিকৃত ছিল এবং জায়গায় জায়গায় লাল নীল আলো দিয়ে সেগুলি জীবন্ত দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। গলি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দেখলাম বিষ্ণুপ্রিয়া এবং শচীমাতার অগোচরে নিমাইয়ের গৃহত্যাগ ও তাদের আর্তনাদের চিত্র। এটা বেশ ভালো বানিয়েছে মনে হল। এরপর আমরা বেরিয়ে সরু অলিগলি ধরে চললাম মূল মন্দিরে।





ক্রমশ..............

আলোকচিত্র সৌজন্যে লেখিকা অদিতি মন্ডল