ফিরে পাওয়া
ঝুম্পা মন্ডল,
ডায়মন্ড হারবার, দঃ ২৪-পরগনা
এই কোয়ার্টারে কস্তুরীরা এসেছে ছয় মাস হলো, তার বরের বদলির চাকরি,
কোয়ার্টার টার পিছনের একটা ছোট বাগান, জানালা দিয়ে দেখা যায়.. বেশ বড়ো
ছোট গাছে ভরা।
সেদিন রাত্রে প্রচন্ড ঝড় থামতেই মাঝ রাত্রে এক মহিলার আর্তচিৎকার শুনে
ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো কস্তুরী আর তার বর কৌশিকের , চিৎকারটা পিছনের বাগান
দিয়েই এসেছিলো।
কারেন্ট অফ বলে কৌশিক তাড়াতাড়ি টর্চ জ্বালিয়ে জানালা দিয়ে দেখতে চাইলো
বাগানের দিকে।
টর্চের আলোয় আধা অন্ধকারে বোঝা গেলো বাগানের আম,লিচু আর কাঁঠাল গাছ সহ
অনেক গাছ প্রায় উপরে গেছে ভীষণ ঝড়ে, সেই সঙ্গে পাঁচিলের একদম গায়ে
কৃষ্ণচূড়া গাছটাও একদম শিকড় ছিঁড়ে উল্টে পড়ে আছে।
আর সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে কেউ যেন উপুড় হয়ে কিছু একটা করছেন, টর্চের
আলো পড়তে লোকটা পিছনে ফিরে তাকালো।
অল্প আলোয় দেখা গেলো পিছনের বাড়ির গাঙ্গুলীমশাই, কিযে করছেন এই অন্ধকারে
ঠিক ঠাওর করতে পারছিলোনা ওরা দুজনে।
গায়ে আলো পড়তে ওদের দিকে ফিরে ব্যাকুল ভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন তিনি,
কিছু বিপদ হয়েছে বুঝতে পেরে কস্তুরীর আর তার বর তাড়াতাড়ি করে পিছনের
দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গাছটার নিচে গিয়ে দেখলো, গাঙ্গুলী বাবুর স্ত্রী অজ্ঞান
হয়ে কৃষ্ণচূড়ার গাছটার গোড়ায় পরে আছেন, তাকে একা টেনে তুলতে পারছেননা
বৃদ্ধ মানুষটি।
ব্যাপারটা কিছুই বুঝলো না কস্তুরী, এতো রাত্রে ঝড় থামতেই গাঙ্গুলীগিন্নি
এই পরিস্থিতিতে এই বাগানে এলেন কেন??
কৌশিক তাকে ইশারা করে ঘরে যেতে বললো, ঘরে তাদের পাঁচবছরের ছোট ছেলে শুয়ে
আছে একা, হটাত ঘুম ভাঙলে কাউকে দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে কাঁদতে পারে।
কস্তুরী মনের মধ্যে অস্বস্তি আর অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে ঘরে এলো।
কৌশিক আর গাঙ্গুলী মশাই ধরাধরি করে গাঙ্গুলীগিন্নিকে ঘরের ভিতরে নিয়ে
গেলেন।
এই গাঙ্গুলীবাবু আর গাঙ্গুলীগিন্নি দুই বয়স্ক মানুষ, দুজনে একটু অন্যরকম,
ওনারা দুজনে একাই থাকেন। কারোর সাথে কথা বলেননা, কারোর সাথে মেশেননা,
ওনার স্ত্রী পাগল মত, সারাদিন পিছনের বাগানে ঘোরা ঘুরি করেন।
এখানে আসার পরেই কস্তুরী কাজের মাসির কাছে শুনেছিলো.." পিছনের জানলা দিয়ে
দেখবে কত রঙ্গ বাগানের মধ্যে, "বলেই মুখ বেঁকিয়েছিল কাজের মাসি।
বাগানটা তাদের কোয়ার্টারের পিছনে, একদম গায়েই, বাগানের পরেই গাঙ্গুলীমশাই
এর বাড়ি।
সত্যিই কস্তুরী আড়াল থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখেছে.. সারাদিনে অন্তত দশ
বারোবার গাঙ্গুলীগিন্নি কৃষ্ণচূড়া গাছটার কাছে এসে কি যেন বিরবির করেন,
আবার কখনো একা একা হাসেন, গাছ টাকে জড়িয়ে ধরে আদর পর্যন্ত করেন।
কস্তুরী মনে মনে অবাক হয় আর ভাবে পৃথিবীতে কত রকমের যে পাগল আছে !
একএক দিন তো বাড়ি যেতেই চাননা, গাঙ্গুলি মশাই তখন জোর করে ডেকে বুঝিয়ে
ওনাকে ঘরে নিয়ে যান।
কস্তুরীর কেমন অস্বস্তিও হয়, সত্যিই বলে তাহলে কাজের মাসি।
ভদ্রমহিলার মাথায় সমস্যা আছে!! এসব পাগলা পাগলী দেখলে তার আবার বড্ড ভয়
করে।
এর মধ্যে একদিন দুপুরে কস্তুরী ছেলেকে খাওয়াচ্ছিলো ঘরে বসে, কৌশিক অফিসে,
ছেলে রোজকার মতো বায়না করছিলো খাবেনা বলে।কস্তুরী যতবার গালে ভাত দেয়
ততোবার ছেলে থু করে ভাত ফেলে দেয়, নিরুপায় কস্তুরী রেগে গিয়ে ছেলের গালে
ছোট্ট একটা চড় মারতেই ছেলে একেবারে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো।
এমন সময় গাঙ্গুলীগিন্নি তাদের ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে আর্তনাদ করে
বললো.. "ওমা বাবুকে মারছিস কেন, মারিসনি, একদম মারতে নেই রে। "
জানালা দিয়ে হটাত এই ভাবে গাঙ্গুলীগিন্নি কথা বলাতে কস্তুরী কেমন যেন ভয়
পেয়ে গিয়েছিলো।
তাছাড়া এইভাবে অন্যের জানলায় উঁকি মারা, এ কেমন অভদ্রতা ! তবুও প্রতিবেশী
হয়, তাই সামান্য হেসে বলেছিলো "দেখুননা মাসিমা কিছুতেই খাচ্ছেনা।"
সঙ্গে সঙ্গে উনি ভীষণ বেদনার গলায় বললেন.. "খেতে হবেনা ওকে, খিদে পেলে
ঠিক খাবে, কিন্তু মারিসনা বাবুকে, উফফফ কিযে কষ্ট।" বলে বুকে খুব কষ্ট
হচ্ছে এইরকম ভাবে নিজের বুকে হাত বোলাতে বোলাতে ছুটে চলে গিয়েছিলেন
তিনি।
কস্তুরী খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলো, তারপরে জানলা দিয়ে দেখে কৃষ্ণ চূড়ার
গাছটাকে জড়িয়ে ধরে মাথা ঠুকছে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
অদ্ভুত লেগেছিলো কস্তুরীর, কিসের কষ্ট ওনার !!
একদিন কাজের মাসিকে জিজ্ঞেস করতে কাজের মাসি মুখ ঝামটে বলেছিলো.. "মা
হয়ে নিজের ছেলেকে মেরে ফেললে পাগল হবেনা তো কি হবে? পাপ কোথায় যাবে?"
শুনে কস্তুরী শিউরে উঠেছিলো, নিজের ছেলেকে মেরে ফেলেছে? একি অলুক্ষুনে
কথা! কিভাবে সম্ভব এটা?
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভয়ে তাড়াতাড়ি কোয়ার্টারের পিছনের জানালাটা বন্ধ
করে দিয়েছিলো কস্তুরী।
তারপর কস্তুরী দেখেছে মাঝে মাঝে গাছের আম, জামরুল ওদের পিছনের দরজার কাছে
জড়ো করে রেখে গেছে কে, অনুমান করে কস্তুরী, কিন্তু কোনোদিন ওসব ফল মূল
ছুঁয়েও দেখনি সে, ছেলেকে দেওয়া তো দূরের কথা।
ইদানিং আরও একটা সমস্যা হয়েছে, ওর ছেলে কাঁদলেই উনি প্রায় বন্ধ জানালার
কাছে এসে ধাক্কা দিয়ে বলেন.." মারিসনা বাবুকে , ব্যথা পাবে, বড্ড ব্যথা
পাবে।"
কথা গুলো শুনে কান্না থামিয়ে তার ছেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে বন্ধ জানালার
দিকে, কিন্তু কস্তুরী আর ওই জানালা খোলেনি কোনোসময়, কিজানি কি আছে মনে,
নিজের ছেলেকে যখন মেরেছে, তখন ওই পাগলকে আর ভরসা কি !!
এইসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল কস্তুরী জানেনা। সেই ঝড়ের রাতের শেষে
ভোরের দিকে কৌশিক ফিরলো, হাত মুখ ধুয়ে এসে ক্লান্ত ভাবে খাটে বসতেই
কস্তুরী জিজ্ঞেস করলো" কি হলো? কেমন আছেন এখন? "
ভীষণ মনখারাপের সঙ্গে কৌশিক বললো.. "জ্ঞান ফিরতেই ভীষণ কান্না কাটি
করছিলেন, ডাক্তার এসে ইনজেকশন দিয়েছেন , উনি এখন ঘুমাচ্ছেন।"
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌশিক বলল.."কত রকম যে দুঃখ আছে মানুষের , আজ
স্ত্রীর ওমন দশা দেখে মেসোমশাই বড্ড ভেঙে পড়েছেন, আমার হাত ধরে কাঁদতে
কাঁদতে কত কথা বললেন।"
কস্তুরী উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইলো স্বামীর দিকে, বুঝলো তার স্বামী ভীষণ
কষ্ট পাচ্ছেন কোনো কারণে।
কৌশিকের পাশে বসে কস্তুরী তার হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে হালকা চাপ দিলো।
কৌশিক বললো.."সন্তানশোক জীবনের সবথেকে বড়ো শোক.. জানো? "
কস্তুরী বললো.. "হ্যাঁ শুনেছি উনি নাকি নিজের হাতে ছেলেকে.. "
কৌশিক দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলো.. "উফফফ না গো না, চুপ করো, কিকরে
ভাবলে তুমি? বাইরের লোকেরা কত টুকু আর জানে?
গাঙ্গুলী মশাই এর কাছেই শুনলাম আজ. ওনাদের ছেলের যখন বছর সাতেক বয়স তখন
কোথাও থেকে ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটা নিয়ে এসে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে বসায় ,
নিজের হাতে পোঁতা গাছ ধীরে ধীরে যখন বাড়তে লাগলো .. তখন ছেলে ভীষণ খুশি
হয়ে প্রায় প্রতিদিন মাকে জোর করে বাগানে এনে দেখাতে চাইত।.. কেমন ভাবে
তার হাতে বসানো গাছটা দিনে দিনে বাড়ছে , সে বইয়ে পড়েছে, গাছেরও প্রাণ
আছে, সারাদিন এই গাছ টা জুড়েই খেলা ছিলো তার, প্রতিদিন গাছ টাকে দেখতো আর
গাছটার নতুন নতুন পাতা, কচি কচি ডাল আবিষ্কার করে অবাক হয়ে যেত।
ছোট মানুষরা যে সব ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে যারপরনাই মেতে থাকতে পারে, বড়োদের
কাছে স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলো অতিশয় তুচ্ছ মনে হয়।
তাই প্রথম প্রথম ছেলের পাগলামিতে কিছু না বললেও গাঙ্গুলীগিন্নি ছেলেকে
একদিন একটু বকা দিয়েছিলেন..কারণ গাছটার নেশায় ছেলে মাঝে মাঝে স্কুল না
যাওয়ার বায়না ধরছিলো, মায়ের ধারণা হলো সবসময় গাছ নিয়ে সময় কাটিয়ে স্কুল
আর পড়াশোনায় ফাঁকি দিচ্ছে ছেলে, মায়ের হালকা বকুনি দুরন্ত ছেলে পাত্তাই
দিলোনা, সে চললো তার নিজের নিয়মে।
এর কয়েক দিন পরে সন্ধ্যাবেলায় পড়াতে বসে গাঙ্গুলীগিন্নি হটাত খেয়াল করেন
অংক না করে অংক খাতার নিচে ছেলে আঁকার খাতা নিয়ে এক মনে কৃষ্ণচূড়া গাছ
এঁকেছে , তাতে হেলান দিয়ে নিজেকে এঁকে পাশে লিখেছে.."আমার প্রিয় বন্ধু।"
অংক না করে ছবি এঁকে ফাঁকি মারার জন্য রাগের মাথায় মাসিমা ছেলেকে একটা চড়
মারেন, সব মায়েরাই ছেলে মেয়েদের এমন টুকটাক মেরেই থাকেন পড়াশুনায় ফাঁকি
দিলে।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ছেলে বমি করতে থাকে, সেই সময় গাঙ্গুলি বাবু অফিস
থেকেও ফেরেননি, মাসিমা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি, ছেলের কি হলো, তারপর
হাসপাতালে নিয়ে যাবার আগেই সব শেষ, হাসপাতালে পোস্টমর্টম রিপোর্ট এ
ডাক্তার কথা অনুযায়ী .. "রগে কোনোভাবে আঘাত পাওয়ার ফলে মৃত্যু হয়েছে
বাচ্ছাটার। "
এইটুকু বলে কৌশিক কস্তুরীর দিকে তাকিয়ে বিষাদ মাখা গলায় বললো .. "ভাবো
তো, কি পরিস্থিতি, সবাই তখন ওনাকে জিজ্ঞেস করছে, কিভাবে লাগলো ছেলের
রগে? উনি তখন দিশেহারা ছেলের শোকে, নিজেকে আর সামলাতে পারেননি, তিনি তো
তেমন জোরে মারেননি ছেলেকে, কিকরে এমন হলো সেটা ভাবার থেকে নিজে মা হয়ে
ছেলেকে মেরে ফেলেছেন, এটা ভেবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারলেননা উনি।
এর থেকে ভয়ংকর কষ্ট এই পৃথিবীতে কি আর হতে পারে??
শোকে দুঃখে বদ্ধ উন্মাদের মতো হয়ে গিয়েছিলেন, তারউপর জানোই তো কিছু মানুষ
থাকেই যারা দোষ দিতেই থাকে।"
কস্তুরীর বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে, এখন বুঝল তার ছেলেকে ঐদিন মারতে উনি কেন
ওমন আর্তনাদ করে বারণ করেছিলেন"..নিজের ছেলেকে বুকে চেপে ধরলো কস্তুরী,
মা হয়ে সে বুঝতে পারলো গাঙ্গুলীগিন্নির মর্মান্তিক কষ্টটা,
কৌশিক আবার বললো, " ওনাদের বেশি বয়সের সন্তান ছিলো বাচ্ছাটা,তাই আর
সম্ভাবনাও ছিলোনা নতুন ইস্যু নেবার, স্ত্রীকে পুত্রশোক থেকে স্বাভাবিক
জীবনে ফিরে আনানোর জন্য আত্মীয় স্বজনদের তেরা কথা , পাড়া পড়শীদের বাঁকা
চোখে তাকানো দেখে কষ্ট পেতে পারেন ভেবে সবার সাথে মেলামেশাও বন্ধ করে
দেন মেসোমশাই , কয়েকবার সুইসাইড করতেও যান গাঙ্গুলীগিন্নি, ওই
পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে কিভাবে সামলাবেন একা বুঝে উঠতে পারছিলেন না, নিজেও
মনের দিক থেকে ভেঙে পড়ছিলেন ভীষণ।
তারমধ্যে একদিন ভোরে ঘুম ভেঙে দেখেন বাগানের এই কৃষ্ণচূড়ার গাছটাকে
জড়িয়ে আদর করছেন ওনার স্ত্রী , আর পরম স্নেহের সাথে কি সব বলছেন, দেখলে
মনে হচ্ছিলো ছোট্ট গাছটাও পাতা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলছে ওনার সাথে।
গাঙ্গুলীমশাইকে দেখে এক গাল হাসি দিয়ে ওনার স্ত্রী বললো , "বাবু স্বপ্নে
এসেছিলো একটু আগে, এইখানে দাঁড়িয়ে হাসছিলো .. ও এখানেই আছে, হ্যাঁ গো
ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় না? ".. বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করেই পরম
বিশ্বাসে গাছটাকে আবার আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি, ঠিক যেন ছেলেকে জড়িয়ে
আদর করছেন।
দীর্ঘদিন পরে স্ত্রীর সেই হাসি মুখ দেখে মনে মনে ভীষণ স্বস্তি পেলেন ,
তারপর ধীরে ধীরে তার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠলেন, ওই গাছটিই বাঁচিয়ে দিল তার
গিন্নিকে।গাঙ্গুলি বাবু বুঝলেন কোনও এক বিশেষ কারণে এই কৃষ্ণচূড়া
গাছটিকেই নিজের ছেলে ভেবেছেন তার গিন্নি।
গাঙ্গুলী মশাই তাই এসবে কোনোদিন বাঁধা দেননি, স্ত্রী যাতে ভালো থাকে
বরাবর সেই চেষ্টাই করে গেছেন তিনি, আজ দীর্ঘ পয়তিরিশ বছর ধরে এমন চলে
আসছিলো।
কিন্তু ওইদিন ওই ভীষণ ঝড়ের রাতে ঘরের মধ্যে ওনাকে ধরে রাখা যাচ্ছিলোনা
কিছুতেই।
বার বার দরজা খুলে বেড়িয়ে আসতে চাইছিলেন তিনি গাছটার কাছে ,কোনোরকমে আটকে
রেখেছিলেন স্ত্রীকে, সেই মুহূর্তটুকু স্ত্রীর সেই বুক চাপড়ে কান্না দেখে
তিনিও আসন্ন বিপদের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠে ছিলেন।
ঝড় একটু থামতেই সেই রাত্রেই ওনার স্ত্রী দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন কৃষ্ণচূড়া
গাছের কাছে, তারপর তো দেখলে কি হলো।"
কস্তুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো এই ভেবে .. দ্বিতীয় বার সন্তানহারা হলেন
গাঙ্গুলীগিন্নি।
দিন দুই পরে ওনাদের বাড়ি গেলো তারা,এই কদিনে কেমন যেন আত্মীয়ের টান অনুভব
করছিলেন দুই বাড়িই।তারা দেখল ঘরে খাটের মধ্যে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন
গাঙ্গুলীগিন্নি।
গাঙ্গুলীমশাই তাদেরকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন, বললেন.. আজ দুই দিন গিন্নি
একবারও চোখ মেলেনি।একটাও কথা বলেনি আমার সাথে , কিছু খায়নি, এযাত্রায়
বোধহয় বাঁচানো যাবেনা তাকে আর, ইচ্ছে করে কেউ যদি বাঁচতে না চায়, তাকে
কিভাবে, কোন উপায়ে বাঁচাবেন তিনি? কথাগুলো বলে বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন।
শুনে ভীষণ মন খারাপ লাগছিলো কস্তুরীর, কিন্তু এরই মধ্যে কৌশিক হটাত খেয়াল
করলো ছেলে আসে পাশে কোথাও নেই !!
এদিক ওদিক দেখে ছেলেকে দেখতে না পেয়ে বাগানে খুঁজতে গেলো তারা , এতো
দুস্টু আর ছটপটে , এক মুহূর্ত স্থির নেই।
এমন সময় গাঙ্গুলিমশাই তাদেরকে ইশারায় ডাকতে তারা নিঃশব্দে কাছে গিয়ে
গাঙ্গুলীগিন্নির ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলো,
তাদের ছেলে গাঙ্গুলীগিন্নির বিছানায় তার কোল ঘেঁষে বসে নানারকম অঙ্গ
ভঙ্গী করে কি যেন বকর বকর করে যাচ্ছে আর গাঙ্গুলীগিন্নি.. যিনি এই
দুইদিন চোখ খুলেও তাকাতে চাননি , তিনি এই অসুস্থ শরীরেও ছেলের বক বকানি
শুনছেন মুখের মধ্যে অনাবিল হাসি আর চোখের কোনে জল নিয়ে।
গাঙ্গুলি মশাই স্ত্রীর মুখে আবার সেই হাসি দেখে পরম খুশিতে কৌশিকের হাত
চেপে ধরলেন,এ যাত্রায় হয়তো গিন্নিকে আবার ফিরে পেলেন এই ভেবে, তারপর
তাড়াতাড়ি গরম দুধ আর ওষুধ আনতে দৌড়ালেন তিনি।
এতদিন ভয়ে ছেলেকে গাঙ্গুলীগিন্নির কাছে আসতে না দিলেও আজ কেন জানেনা
ছেলেকে ওনার এতো কাছে বসে বকরবকর করতে দেখে কস্তুরীর চোখে নিজের অজান্তে
জল চলে এলেও মনটা তার হালকা লাগছিলো ভীষণ।