বিউইল্ডারমেন্ট
উজ্জ্বল দাস,
কলকাতা
-বিপাশা না?
-অভি তুই!
-বিপাশা তুই!
হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো বিপাশা। অভির বুকটা কিছুক্ষনের জন্য হয়ে উঠলো
বিপাশার শেষ আশ্রয়।
কলেজ ছাড়ার পর আর কখনো দেখা হয়নি ওদের। দেখাটা ঠিক এরকম ভাবে হবে দুজনের
কেউই ভাবতেও পারেনি। এক সময় দুজনেই মন দিয়ে ফেলে দুজনকে। কিন্তু বাধ সাধে
বিধি। কিছুতেই বিপাশার ব্যারিস্টার বাবা অভির সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হননি।
অতি সাধারণ ঘরের ছেলে অভি। বিশেষ প্রতিষ্ঠিতও নয় ওদের ফ্যামিলি। তাই
বিপাশার বাবা মেয়ের জীবন সঙ্গী হিসেবে ঠিক করে রেখে ছিলেন তার বন্ধুর
উকিল ছেলেকে।
||২||
বর্ষায় আজ প্রচন্ড উথাল পাথাল করছিলো গঙ্গা। সেটা হয়তো মাঝি ভাই বুঝতে
পারেনি। নাহলে এই মুষলধারে বৃষ্টিতে কখনো মাঝ গঙ্গায় নৌকো নিয়ে যাবার
সাহস করতেন না। সঙ্গে প্রায় চৌষট্টি জন যাত্রী, মানে যত জন যাত্রী তোলার
কথা তার থেকে অন্তত ঊনিশ জন বেশি। যাত্রীরা সব সময়ই তাড়াহুড়ো করতে থাকেন।
তাই তারা ভরসা করে চেপে বসে ছিলেন নৌকোয়। মাত্র একটা দমকা হাওয়ায় ভয়ানক
দুলে উঠে হেলে গিয়েছিলো নৌকোটা। তাতেই সবার মুখ রক্ত শূন্য হয়ে গেছিলো।
বিপাশা ভয়ে চোখ বন্ধ করে অনির্বানের হাতটা চেপে ঠাকুরকে ডাকছিলো অনবরত।
চোখ বন্ধ করেই বিপাশা মাঝির গলার আওয়াজ পাচ্ছিলো কানে। যে তিনি নাকি এই
ঘাটে প্রায় তেইশ বছর নৌকো চালাচ্ছেন। এমন ভাবে তার মন কখনো কু ডাকেনি
আগে। এই ঝড়ো হাওয়া একদম অপরিচিত তার কাছে। তাই সবাইকে ভয় না দেখিয়ে
বারবার সাবধান করে দিচ্ছিলেন। নানা রকম অভিজ্ঞতার গল্প করছিলেন। যদি কিছু
অঘটন ঘটে কী করতে হয় এই বিপদকালে। সেসব সবার কানে ঢুকেছিলো কিনা জানা
নেই।
পরস্পর দমকা হাওয়া আসতেই থাকে। মাঝিভাই পারেনি সেদিন শেষ রক্ষা করতে। ঠিক
মাঝ বরাবর আসার আগেই একটা এলোপাতাড়ি হাওয়া এসে উল্টে দেয় ভুটভুটি নৌকোটা।
বহু কষ্টেও টাল সামলাতে পারেনি অভিজ্ঞ মাঝি । চৌষট্টি জন যাত্রীর সবাই
সেদিন উল্টে গেছিলো মাঝ গঙ্গায়। মাঝি কিন্তু নিজে পালিয়ে না গিয়ে সবাইকে
ভেসে থাকার পরামর্শ দিচ্ছিলো যতক্ষন না উদ্ধার করার জন্য অন্য নৌকা আসে।
কেউ ভুটভুটির বসার কাঠের বেঞ্চি কেউ বা কাঠের পাটাতন ধরে বেশ কিছুক্ষন
নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে ছিলেন।
||৩||
বিপাশা আর অনির্বাণও ব্যতিক্রম নয়। তারাও চেষ্টা করেছে নিজেদের বাঁচিয়ে
রাখতে বলাই বাহুল্য। অনির্বানের ব্রিদিং প্রবলেম একটা ছিলোই। আর সেটা
ইদানিং তাকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল। সেই কারণেই গঙ্গার অন্য পাড়ে সেদিন
ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলো দুজনে। এমত অবস্থায় অনির্বাণ পারেনি নিজের শরীরে
অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে যেতে। মাঝ গঙ্গায় শুরু হয়ে যায় শ্বাসকষ্ট। আর গলগল
করে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে দলা দলা রক্ত।
বুঝতে পারে বিপাশা। তার বাবা তাকে অজান্তেই ভাসিয়ে দিয়েছে। আশা ছাড়ে না
সে। অনি’কে জলে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায় বিপাশা। উদ্ধারকারী নৌকা
আসে এক সময়ে। পাড় থেকে সমস্ত যাত্রীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে যাওয়া হয়
সরকারি হাসপাতালে। জনে জনে পরীক্ষা করে ডাক্তার আর নার্সরা। শুরু হয়
চিকিৎসা। তুলনা মূলক সুস্থ যারা তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। থেকে যায় প্রায়
সাতাশ জন মুমূর্ষু যাত্রী। বিপাশা বসে থাকে অনির্বানের পাশে। ক্রমশ
নিস্তেজ হয়ে আসছে অনির্বাণ। হয়তো বুঝতে পারছে ফুসুফুসের শেষ হাওয়াটা
বেরিয়ে গেছে। সামনে যাকেই পাচ্ছে তাকেই ডেকে ডেকে একবার চেক করতে বলছে
সে।
- ডাক্তেবাবু, ডাক্তারবাবু একবার দেখে যান না, একবার।
-শান্ত হোন ম্যাডাম। আমরা সবাইকে দেখছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
-ডাক্তারবাবু আমাদের মাত্র সাত মাস বিয়ে হয়েছে। একবার, প্লিস,
একবার...
-সরি ম্যাডাম, হি ইজ নো মোর! সো সরি।
-নট পসেবল্ ডক্টর, প্লিস চেক ওয়ান্স। প্লিস!
বিপাশার কাতর অনুরোধে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার অভিরূপ
বসু মুখ তুলেই দেখে তার কলেজকালের প্রেম বিপাশা। কান্নায় ভেঙে পড়ে
বিপাশা। প্রিয় বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে মুখ গুঁজে। বোঝাতে চেষ্টা
করে অভি। হঠাৎ অভিকে ছেড়ে ছিটকে যায় বিপাশা।
-হোয়াট দা ফাক অভি, ইউ হ্যাব কিল্ড মাই অনি, ইউ ডিড ইট্।
-বিপাশা! বিপাশা! মি!? আর ইউ ম্যাড্?
-হ্যাঁ হ্যাঁ আমি পাগল হয়ে গেছি। ইউ ডিড ইট্ টু গেট মি ব্যাক। জাস্ট গেট্
লস্ট্।
-সামলাতে পারেনি অভি বিপাশাকে। পাগলের মত এলো চুলে বেরিয়ে যায় বিপাশা
হাসপাতাল থেকে। পেছনে ডাকতে থাকে অভিরূপ।
-বিপাশা! বিপাশা! বিপাশা!
~সমাপ্ত~