প্রিয়বন্ধু
চন্দ্রমা মুখার্জী,
সমর পল্লী, কলকাতা
১
দুদিন ধরে অঙ্কনের মনখারাপ। মা দেখছে রোজ গোমড়ামুখে স্কুল থেকে ফিরছে।
কালকে ছুটি,আজকে মা ওকে চেপে ধরল – “কি ব্যাপার? দুদিন ধরে মুখ কালো করে
ঘুরছিস কেন? স্কুলে কিছু হয়েছে নাকি?”
অনেক জোরাজুরিতে শেষে অঙ্কন মুখ খুলল,“হ্যাঁ, নীলাভ আসছে না দুদিন ধরে,
কি হয়েছে কেউ জানেনা।“ “এই ব্যাপার, তো আমাকে আগে বলিস নি কেন? দাঁড়া,
আমি নীলাভর মাকে এখনি ফোন করছি।“
২
অঙ্কন আর নীলাভ দুজনে বেস্ট ফ্রেন্ড। ওরা ক্লাস ফোরে পড়ে। ক্লাসেও ওরা
পাশাপাশি বসে। ক্লাসের সবাই বলে মানিকজোড়। যাইহোক, সেই নীলাভই দুদিন ধরে
স্কুলে আসছে না। অঙ্কনের তাই মনখারাপ। যাইহোক, মা নীলাভর মাকে ফোন করতে
গেল।
৩
একটু রিং হতেই নীলাভর মা ফোনটা ধরল – “হ্যালো, কে বলছেন?” অঙ্কনের মা বলল
– “আমি পারমিতা বলছি। তোমার ছেলের কি হয়েছে অমৃতা? দুদিন ধরে স্কুলে
যাচ্ছে না কেন?”
অমৃতা বলল – “নীলাভর গত বুধবার স্কুল থেকে ফিরে মনটা খারাপ ছিল। কারণ
জিজ্ঞেস করাতে কিছুতেই বলল না। তারপর রাত থেকে ধুম জ্বর। জ্বরের ঘোরে
খালি বলছে, ‘আমি দেখে লিখিনি।‘ ডাক্তার দেখে বলেছে যে, কোন কিছু থেকে শক
পেয়ে এইরকম হয়েছে। কিন্তু কি হয়েছে তা ওকে জিজ্ঞেস করতেই পারছি না। আজকে
একটু জ্বর কমেছে। দুদিন দেখি, ভাল থাকলে সোমবার থেকে স্কুলে যাবে।“
“আচ্ছা,আমি অঙ্কনকে জিজ্ঞেস করছি ও কিছু জানে কিনা” – পারমিতা বলল।
৪
ফোনটা রেখে পারমিতা অঙ্কনকে সব খুলে বলল। সব শুনে অঙ্কনের মুখটা আরও
শুকিয়ে গেল, এই ব্যাপারটা মায়ের চোখ এড়াল না।
মা ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল – “তুই এই ব্যাপারে কিছু জানিস? তাহলে আমাকে
খুলে বল।“ “না, মা – আমি কিছু করিনি” – অঙ্কন বলল।
“আমি তো বলিনি,তুই কিছু করেছিস। তাহলে তুই হঠাৎ এরকম কথা বললি কেন? আর
তাই তোর মুখটা ভয়ে শুকিয়ে গেল। বল তুই কি করেছিস? সব সত্যি বলবি।“ – মা
খুব রেগে গেছে।
অঙ্কন এবার ভয় পেয়ে গেল। মা এমনিতে খুব ভাল, একটুও বকে না। কিন্তু একবার
রেগে গেলে যে কি করবে সেটা অঙ্কন ভাবলেই ভয় পায়। তাই ও গত বুধবার ক্লাসে
হওয়া ঘটনাটা বলতে লাগল।
৫
আগের সপ্তাহের Weekly Testএর খাতা বেরিয়েছিল। সবার খাতা দেওয়ার পর মিস
অঙ্কন আর নীলাভকে ডাকল। তারপর বলল,“দুজনে একইরকম লিখেছো বাংলা রচনাটা
শুরু থেকে শেষ অবধি। আমাকে বলো তো সত্যি করে কে কার দেখে লিখেছো?”
দুজনেই একসাথে বলে উঠল – “আমি দেখে লিখিনি।“ তখন মিস বলল – “তাই? আমি
দেখতে চাইছিলাম যে, তোমাদের মধ্যে সৎসাহস আছে কিনা। কিন্তু নীলাভ তুমি এত
বড়ো মিথ্যে কথা বলছ কি করে? পরিষ্কার দেখছি দুজনে একই লিখেছ, শুধু শেষে
অঙ্কন আরও দুলাইন যোগ করেছে। তাই তো বুঝতে পারলাম কে কার দেখে লিখেছে।
দেখে যে লেখে সে তো আর দুলাইন বেশি লিখবে না। বরং কমই লিখবে।“
নীলাভ আবারও বলল,“না মিস, আমি দেখে লিখিনি। আমি কখনো দেখে লিখি না। যা
জানি তাই লিখি।“ “একদম চুপ করে নিজের জায়গায় বসো। অন্যায় করে আবার মিথ্যে
কথা বলছো।“ – মিস বলল।
আসলে অঙ্কনই নীলাভর দেখে লিখেছিল কিন্তু নিচে আরও দুলাইন লিখে দিয়েছিল।
তাইজন্যই এযাত্রা বেঁচে গেল।
৬
সমস্ত ঘটনাটা শুনে পারমিতা স্তম্ভিত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তার বাক্যস্ফূর্তি
হল না। তারপরই বলতে লাগল,“তোকে এই শিক্ষা দিয়েছি? চুরি করলি আবার
মিথ্যেকথাও বললি। ছিঃ,প্রিয়বন্ধুর নামে মিথ্যে অপবাদ দিতে তোর বাঁধল না?
তোর জন্য ছেলেটা কষ্ট পাচ্ছে। সন্ধ্যেবেলাই আমার সাথে নীলাভর বাড়ি গিয়ে
ওর কাছে ক্ষমা চাইবি। আর সোমবার স্কুলে গিয়ে ক্লাসে সবার সামনে মিসের
কাছে নিজের অন্যায় স্বীকার করবি।“
৭
মায়ের কথামতো অঙ্কন সন্ধ্যেবেলা নীলাভর বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চাইল। নীলাভ
প্রথমটা মুখ ঘুরিয়ে থাকলেও ‘সরি’ শুনে আবার ওর দিকে ফিরল।
এরপর সোমবার স্কুলে গিয়ে অঙ্কন দেখল নীলাভ এসেছে। তবে ওর সাথে কোন কথা
বলছে না। মিস ক্লাসে আসতেই অঙ্কন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“মিস আমি একটা অন্যায়
করেছি। আমি নীলাভর দেখে লিখেছি। ও সত্যি কথাই বলেছিল মিস। আমি সব স্বীকার
করছি।“
৮
এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। সেদিনের পর থেকে ওরা দুজনেই সৎ, সাহসী ও
প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে, আর হয়ে উঠেছে সত্যিকারের প্রিয়বন্ধু।
