অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি

অনিন্দিতা গুড়িয়া,

নিউ-দিল্লি

খুব সাধারণ নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে রচিতা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় 85 শতাংশ নম্বর পেয়ে এবারে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু বিধিবাম, একটা অ্যাক্সিডেন্টে তার বাবা দুটি পা এবং একটি চোখ খুইয়ে পুরোপুরি বাড়িতে বসে গেছেন। মা-বাবা আর তিন ভাই বোনের সংসার। বাবার আয়ের সামান্য কিছু জমানো পয়সায় কতদিন আর পাঁচটা পেট চলে! রচিতা বড় তারপরের বোনটা সবে ক্লাস এইটে আর ভাইটা তো আরো ছোটো ক্লাস ফাইভে পড়ে। এর মধ্যেই হঠাৎ করে একদিন ছোট ভাইয়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, অনেক ছোটাছুটি ডাক্তার বৈদ্য করার পরে জানা গেল ভাইয়ের হার্টে ফুটো আছে এবং দিনে দিনে ছিদ্রের আকার বড় হচ্ছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার অপারেশনের প্রয়োজন। আর অপারেশনের জন্য দরকার অনেকগুলো টাকা। টানাটানির সংসারে পাঁচ জনের পেট চালানোই যেখানে দায় সেখানে চিকিৎসার খরচ আসবে কোথা থেকে? বাবার চিকিৎসা, ভাইয়ের চিকিৎসা পাঁচ-পাঁচটা পেট, চারিদিক অন্ধকার দেখে রচিতা। গত দুবছর যাবত পড়াশোনার খরচ চালাতে সে টিউশনি পড়াচ্ছে। টিউশনি করে যে কটা টাকা পায় তাতে পেটের খোরাক জোগাবে না পড়াশোনা করবে, পড়াশুনা এখন তার কাছে বাহুলতা মাত্র। সাত-পাঁচ ভেবে রচিতা ঠিক করল তার টাকার দরকার তাই সে চাকরি করবে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পাস তার মতন হাজার বাচ্চারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে পেটের খোরাক ভাই বোনদের পড়াশুনা বাবা আর ছোট ভাইটার চিকিৎসা সবকিছু যদি চালাতে হয় ঠিকমতন তাবে তার একটা ভাল চাকরির দরকার, আর এই সামান্য পড়াশুনায় খুব ভালো চাকরি তার পক্ষে পাওয়া ও সম্ভব নয় তা সে বেশ ভালোই জানে। রচিতা দিশেহারা হয়ে পড়ে, কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। আজ তার কলেজে শেষ আসা, এর পর আর কোন দিন কলেজে পড়াই হবেনা রচিতার। ফেরার পথে খুব কাঁদতে থাকে রচিতা। হঠাৎ কাঁধে একটা মৃদু চাপ অনুভব করে পেছন ঘুরে দেখে ভূগোলের প্রফেসর জ্যোৎস্না ম্যাম তার কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন সে কাঁদছে কেন, উত্তরে রচিতা কাঁদতে কাঁদতে তার সমস্ত বৃত্তান্ত খুলে বললো।

সব শুনে ভূগোলের প্রফেসর জ্যোৎস্না ম্যাম বললেন- রচিতা একটা চাকরি আছে কিন্তু তুমি কি করবে? ভালো মাইনে পাবে। কিন্তু চাকরিটা দূরে।

রচিতা ম্যামের দুটো হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, বললো- ভালো মাইনের চাকরি হলে শুধু দূরে কেন পৃথিবীর বাইরে ও যদি হয় আমি করতে রাজি আছি। আমার পরিবারটাকে দাঁড় করাতে হবে। আমার বাবার চিকিৎসা, আমার ভাইয়ের চিকিৎসা, ভাই বোনের পড়াশোনা, সকলের খাওয়া দাওয়া, এই সবকিছুর জন্য আমি জাহান্নামে যেতে ও রাজি আছি।

ম্যাম তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন- না না জাহান্নামে যেতে হবে না, কাজটা ভাল কাজ। তোমাকে কোন ইলিগাল বা কোন নোংরা কাজ করতে হবে না।

কিন্তু তারপরেও এমন কিছু প্রশ্ন চিহ্ন থাকে রচিতা যেটা সর্বসমক্ষে বলা যায় না তুমি এমন একটা চাকরি করবে যা তুমি বাইরে কারো কাছে প্রকাশ করতে পারবে না, এখন তুমি বল তুমি রাজি কিনা।

-তবুও ম্যম চাকরির তো কোন একটা নাম তো হবে, আমি বাড়িতে কি বলব ।

ম্যাম একটু যেন কি চিন্তা করলেন, তারপর বললেন তুমি তো ভালো ছবি আঁকো, বাড়িতে জানাবে তুমি ওই ধরনের কোন সৃষ্টি মূলক কাজের সাথে যুক্ত হতে যাচ্ছ। যদি আমার প্রস্তাব তোমার ঠিক লাগে তাহলে তুমি আমার বাড়িতে কাল সকাল বেলা চলে এসো।

মনের সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে রচিতা পরের দিন সকালবেলা ম্যামের বাড়িতে দেখা করতে যায়। তখন সে জানতে পারে যে ম্যামের স্বামী একজন নামকরা ডাক্তার। তিঁনি তাঁর এক বন্ধুর আইভিএফ সেন্টারে রচিতার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। তবে তাদের শহর থেকে অনেক দূরে একটা খুব বড়ো শহরে। সপ্তাহখানেক এর মধ্যে মা বাবা ভাই বোন সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে রওনা দেয় চাকরির উদ্দেশ্যে বহু দূরের এক অজানা শহরে। শুধু এটুকু জানে ভাল মাইনে পাবে, সবাই ভাল থাকবে, সবকিছু ভালো হবে। ম্যাম যখন ভরসা দিয়েছেন তখন খারাপ কিছু নিশ্চয়ই তার সাথে হবে না।

সত্যিই তার সাথে খারাপ কিছু হলো না।

রচিতা পড়াশোনা জানা সুন্দর গান জানা সুস্বাস্থ্যের অধিকারীনি বেশ লম্বা-চওড়া চটপটে সুন্দরী একটা মেয়ে। সব কিছু পড়ে জেনে বুঝে দশ বছরের কন্ট্রাক্ট সাইন করেছে সে আইভিএফ সেন্টারে। কন্ট্রাক্ট মোতাবেক প্রতিমাসে তার বাড়িতে 30 হাজার টাকা পাঠানো হবে আর ভাইয়ের অপরেশনের জন্য অগ্রিম সাড়ে তিন লাখ টাকা এখনই পাঠানো হবে, প্রতি বছর যাতায়াতের খরচ সহ কুড়ি দিনের জন্য বাড়িতে যাবার সুযোগ পাবে আর সেই সাথে তার থাকা-খাওয়া সবকিছুর দায় দায়িত্ব এখন থেকে ডক্টর অনিরুদ্ধ শ্রীবাস্তবের। এর থেকে ভালো রচিতার জন্য আর কিই বা হতে পারতো!

শহরের বেশ নামকরা এই আইভিএফ সেন্টার টা ডক্টর অনিরুদ্ধ আর তার স্ত্রী ডাক্তার প্রতিমা শ্রীবাস্তবের। দুজনেই ওরা গাইনোকোলজিস্ট।

এখন থেকে রচিতার নতুন পরিচয় RD004 .

বেসমেন্ট সহ পাঁচ তলা এই সুবিশাল আইভিএফ সেন্টারটার সবথেকে উপরের তলায় থাকে রচিতা আর ওর মতো আরো জনা দশেক মেয়ে। যাদের বয়স মোটামুটি ঊনিশ থেকে ত্রিশ এর মধ্যে। প্রত্যেকের জন্যই কমবেশি একই রকম কন্ট্রাক্ট। ঘরে এসি টিভি আলমারি বেড কোন কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু ওই যে বলে না ঘরের ভিতরের বন্ধন নেই আর বাইরের মুক্তি নেই, ওদের অবস্থাটা ঠিক সেইরকমই। প্রত্যেকেই ওরা কখনো ডোনার কখনো বা সারোগেট মাদার এর কাজ করে। ও শুনেছে এই সারোগেসির জন্য ডাক্তার শ্রীবাস্তব প্রায় 25 লক্ষ টাকা নেন, আর আইভিএফ এর জন্য 5 থেকে 7 লক্ষ টাকা। তাঁরা সে যাই নিক তাদের তো কিছু কম করেননি। প্রতিনিয়ত রক্ত পরীক্ষা, সুচিকিৎসা পরিসেবা, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া সব কিছুই করান। শুধু নিজের ন্যূনতম কাজটুকু ছাড়া বাকি কোন কাজ করতে হয় না ওদের। রান্নাবান্না সাফ সাফাই সবকিছুর জন্যই কাজের লোক আছে। ওদেরকে শুধু সকালবেলা সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা সময় মতন খাবার-দাবার খাওয়া সময় মত হালকা এক্সারসাইজ করা ওষুধ খাওয়া আর রেস্ট করা এই ওদের মেইন কাজ, যাতে করে ওরা খুব সুন্দর স্বাস্থ্যকর বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। এবং বাচ্চা গর্ভ মুক্ত হওয়ার পর মাস তিন চারেকের মধ্যেই পরেরবার ওদের গর্ভধারণের কোন অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। তৈরী ভ্রূণ গর্ভে নেবার পর নিজের শরীরে একটু একটু করে একটা নতুন সৃষ্টির আভাস পাওয়া তারপর তাকে গর্ভ মুক্ত করে তার বাবা-মায়ের কাছে তাকে দিয়ে দেওয়া এ যেন সত্যিই এক সৃষ্টি মূলক কাজ।

কাদের সন্তান গর্ভে ধারণ করছে তা জানার অধিকার ওদের নেই তবে কোন মা-বাবা সারোগেসির জন্য এলে গর্ভ নির্বাচন করার অধিকার তাঁদের আছে, তবে অবশ্যই আসল নাম পরিচয় গোপন রেখে আইভিএফ সেন্টার এর নম্বরের পরিচয় এর সাথে। এই মিটিংটা ও বেশ মজার । কাল কাঁচ লাগানো একটা রুমের মধ্যে সেই সময় যারা প্রেগনেন্ট থাকে না সেই সব মেয়েরা পরপর এসে দাঁড়ায়, ভিতর থেকে বাইরের টা দেখা না গেলেও বাইরে থেকে ভেতরের টা পরিষ্কার দেখা যায় । তাই বাবা মায়েরা বাইরে থেকেই তাদের মধ্যে কোন একজনকে নির্বাচন করে তাদের সন্তান গর্ভে ধারণ করার জন্য। তারপর নানা রকম টেস্ট এটা ওটা করে শেষে তৈরি করা ভ্রূণ ওদের গর্ভাশয় এর মধ্যে প্রতিস্থাপন করেন ডক্টর শ্রীবাস্তবরা। দেখতে দেখতে কেটে যায় নটা মাস, নানান অনুকূল -প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে একসময় গর্ভের সন্তান গর্ভ মুক্ত হয়। এর মাস দুয়েক পর ওরা কুড়ি দিন ছুটি পায় বাড়ি থেকে ঘুরে আসার জন্য কিন্তু অবশ্যই আইভিএফ সেন্টার এর সবকিছু গোপন রাখতে ওরা বাধ্য এবং নির্দিষ্ট সময় পর ফিরে আসতে ও ওরা বাধ্য। রচিতা এখানে এসেছে প্রায় আট বছর হল । এখানে রচিতার রেকর্ড খুব ভালো, একটাও বাচ্চা রচিতার থেকে নষ্ট হয়নি এ পর্যন্ত। এখনো অবধি প্রায় গোটা কুড়ি বার ডিম্বাণু ডোনেট করেছে রচিতা আর এই নিয়ে অষ্টম বার গর্ভধারণ করেছে। এই আট বছরে রচিতার বাড়ির অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে , দোতলা পাকা ঘর বানিয়েছে, বোনটাকে গ্রাজুয়েট বানিয়েছে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে। ভাইটাও সুস্থ এখন, কলেজে পড়ছে । বাবাও একটু একটু চলাফেরা করছে। এখন সংসার এর অবস্থা খুবই সচ্ছল । জমি কিনেছে, পুকুর কাটিয়েছে, এখন জমির ধান পুকুরের মাছ বাগানের ফল-সব্জি কোনো কিছুরই অভাব নেই।

শুধু রচিতার জীবনের কোনো পরিবর্তন হয়নি । তার জীবনটা এখনো সেই বাঁধা গৎ এ পড়ে আছে। মাঝে মাঝে মনটা বিদ্রোহ করে ওঠে, একটু একটু করে একটা ভ্রূণ কে নিজের গর্ভে রেখে তাকে বড় করা, মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে তার জন্ম দেওয়া। এই নাড়ী ছেঁড়া ধণকে এক মুহুর্ত আদর করার উপায় ও নেই। যে সন্তানের জন্ম দিল সে ছেলে কি মেয়ে সেটা জানার অধিকার ও তাদের নেই। জন্মের পর তাকে তুলে দিতে হয় তার আসল মা-বাবার কাছে। ভালো লাগে না, কিছুতেই ভালো লাগেনা রচিতার কিন্তু কি করবে সে! বুকের দুধে বুক ভারি হয়ে থাকে, যন্ত্রনায় টনটন করে। কত আর পাম্প করে করে ফেলে দেয়া যায়। ডাক্তারের অসুধের গুনে একসময় বুকের দুধ বুকেই শুকিয়ে যায়। তারপরেই তো তাদের ছুটি মেলে কুড়ি দিনের জন্য।

সাবধানতা অবলম্বন করা সত্বেও কেমন করে না জানি এই অষ্টম গর্ভের সন্তান ঘুরে গিয়েছিল। এই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলো রচিতা। কেন জানিনা এই প্রথমবার কোন বাচ্চাকে রচিতা তার নিজের কাছে রাখার সুযোগ পেল এক মাসের জন্য। মাথা কোঁকড়া কালো চুল ফর্সা নাদুস নুদুস কন্যা সন্তান। ডাক্তার শ্রীবাস্তবের কড়া বারণ সত্তেও নিজের বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত রাখতে পারেনি সে শিশুকন্যাকে। পনের দিনের মধ্যেই বাচ্চাটা বেশ দুরন্ত হয়ে উঠেছে। দুধ খাওয়ার সময় বাচ্চাটা যখন রচিতার স্তনবৃন্ত মুখে নিয়ে আকর্ষণ করে তখন রচিতার মধ্যে এক পরম তৃপ্তির নৈসর্গিক সুখ অনুভূত হয়। বাচ্চাটার ছোট ছোট হাতের নরম আঙ্গুলের পাতলা ধারালো নখের আঁচড় তার বুকে যেন মাতৃত্বের আলপনা এঁকে দেয়। এই প্রথমবার রচিতা মা হওয়ার সুখ লাভ করে। যখন বাচ্চাটা ঘুমোয় রচিতা একদৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন বাচ্চাটা খেলে তখন তার মনটা কানায় কানায় ভরে ওঠে। মনে মনে রচিতা তার একটা নাম ও ঠিক করে ফেলেছে। বাচ্চাটা এত টরটরি তাই ও ঠিক করেছে ওর নাম রাখবে তার সবথেকে প্রিয় রাগের নামে- টোড়ী।

ছোট্ট শিশু এরমধ্যেই মায়ের বুকের দুধ আর কৌটোর দুধ আলাদা করে চিনতে শিখেছে। খিদে পেলে ফিডিং বোতলে দুধ দিলে জিভ দিয়ে ঠেলে বাইরে বের করে দেয়, কিছুতেই সে বোতলের দুধ খাবেনা। সে খুঁজে বেড়ায় মায়ের বুকের দুধ। এই সব দেখে শুনে রচিতার মনে বেশ কৌতুকের উদ্রেক হয়। এক অন্যরকম ভাললাগা জন্ম নেয়।

দেখতে দেখতে কেটে গেল প্রায় এক মাস, একদিন সকালে ডাক্তার প্রতিমা এসে নিয়ে গেলেন শিশুকন্যাটিকে রচিতার মনটা হাহাকার করে উঠলো। এমন যন্ত্রণা এমন কষ্ট এর আগে সে কোনোদিন অনুভব করেনি। যখন তার বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হল, যখন তার ভাইয়ের হার্টের ছিদ্রের কথা জানতে পারল, যখন সে তার প্রাণাধিক প্রিয় পড়াশোনা কে ছেড়ে কলেজকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাড়ি থেকে দূর শহরে চলে এলো, এর আগে যখন সে আরো সাতটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে তাদের মুখ পর্যন্ত না দেখে তাদের বাবা মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিল তখনো ওই ধরনের দুঃখ অনুভব করেনি। কেঁদে কেঁদে রচিতার শরীর ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। চোখের জলে বাধ মানে না কিছুতেই, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে এর থেকে মরে যাওয়া ও বোধহয় অনেক বেশি ভালো অনেক বেশি শান্তির। রচিতার কেমন পাগল পাগল অনুভব হতে লাগল। অনেক বোঝালেন ডাক্তার শ্রীবাস্তব কিন্তু মায়ের মন বোঝায় কার সাধ্য। এর মাস দুয়েক পরে ছুটি পেয়ে কুড়ি দিনের জন্য বাড়িতে গেল রচিতা। তখনো তার বুকে অসম্ভব ব্যথা। ব্যথা বুকে নিয়ে বাড়িতে গেল কুড়ি দিন বাড়িতে রইল তারপর আবার ফিরে এল সে তার নির্দিষ্ট জায়গায়। এখনও দু বছরের মেয়াদ বাকি আছে। আজকাল রচিতার শরীর টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না। কেমন গা বমি বমি করে, মাথা ভার ভার লাগে, একটু একটু জর ও হয় কখনো কখনো। বুকে অসম্ভব ব্যথা যন্ত্রনা। সব দেখে শুনে ডক্টর প্রতিমা শ্রীবাস্তব রচিতা কে পাঠালেন অঙ্কোলজিস্ট ডাক্তার মেঘাদ্রীর কাছে। রচিতা কে পরীক্ষা করে ডাক্তার মেঘাদ্রি জানালেন ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে রচিতার এবং ইমিডিয়েটলি অপারেশন করতে হবে। কি আর করা যাবে অগত্যা ডাক্তার প্রতিমা ও ডাক্তার অনিরুদ্ধ শ্রীবাস্তবের দয়ায় অঙ্কোলজিস্ট সার্জন ডাক্তার মেঘাদ্রীর হাতেই অপারেশন হলো রচিতা। দুটো স্তনই কেটে বাদ দিতে হলো তার জীবন বাঁচাতে। মনে মনে রচিতা ভাবলো এই বেশ ভাল হল যে স্তন শিশুর জন্য নয় তা থাকাও যা না থাকাও তা।

সম্পূর্ণ সুস্থ হতে রচিতার প্রায় সাত-আট মাস লেগে গেল। এ পর্যন্ত ডক্টর প্রতিমা পাশেই ছিলেন তারপর তিনিও হাত তুলে নিয়েছেন রচিতার মাথা থেকে। সরি বলে দুঃখ প্রকাশ করে তার সামনেই কন্ট্রাক্ট পেপার টা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ডক্টর শ্রীবাস্তব রচিতা কে বললেন -তুমি এখন মুক্ত রচিতা ।

এর অর্থ যে কি হয় রচিতা তা খুব ভালোই জানে। তার এই গত আট নয় বছরের সেল্টার টিও আর রইল না তার । এখন রচিতা কি করবে কোথায় যাবে?

সে তার মা কে ফোন করলো তার সমস্ত ঘটনা জানালো তার শরীরের অবস্থা জানালো।

তিনি দুঃখ করে বললেন- তোর দুটো স্তনই নেই মেয়েদের আসল যেটা দরকার, তোর তো কোনদিন বিয়েও দিতে পারব না । আর আমার ঘরের এখনো অবস্থা সে রকম ফেরেনি যে আমি তোকে ঘরে বসিয়ে খাওয়াবো। তার ওপরে তুই বিয়ে না করে এতগুলো বাচ্চার জন্ম দিয়েছিস এ কথা যদি জানাজানি হয় তবে আমি সমাজে মুখ দেখাবো কি করে? তার চাইতে তুই তোর অন্য কোনো ব্যবস্থা দেখে নে মা, আমাদের দিন যেমন তেমন করে কেটে যাবে। এই বলে তিনি ফোনটা রেখে দিলেন। হায়রে বিধাতা! যাদের জন্য এত কৃচ্ছসাধন সেই তাদের কাছেও সে আজকে বোঝার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন কোথায় যাবে রচিতা? তবে কি সে আত্মহত্যা করে নিজের জীবন শেষ করে দেবে?

কিন্তু মানুষ ভাবে যা আর হয় আরেক। অলক্ষ্যে থেকে যিনি কলকাঠি সবকিছু নাড়েন তাঁর ইশারা ব্যতীত কিছুই যে হবার নয়।

কেমন করে না জানি খবর পেয়ে ডক্টর মেঘাদ্রি আগে থেকেই নিজের গাড়ি নিয়ে আইভিএফ সেন্টারের গেটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রচিতা গেট থেকে বাইরে বের হতেই ডক্টর মেঘাদ্রি রচিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

বললেন -রচিতা আপনার কাছে আমার একটা প্রস্তাব ছিল, যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাই আপনি কি যাবেন?

খুব অবাক হয় রচিতা, হঠাৎ ডক্টর মেঘাদ্রি কেন তার কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে এলেন তা রচিতা বুঝে উঠতে পারলোনা। তাসত্ত্বেও ডাক্তার মেঘাদ্রীর গাড়িতে উঠে বসে রচিতা। গত বেশ কয়েক মাস ধরে দেখা ডাক্তার মেঘাদ্রি আজকে যেন তার চোখে অন্যরকম দেখাচ্ছেন। আজ তার পরনে না আছে সার্জেন্টের এপ্রিন না আছে ডাক্তারের কোট স্টেথোস্কোপ। আজকে ডাক্তার মেঘাদ্রীর পরনে একটা নীল সুট। বছর আটচল্লিশ এর ডাক্তার মেঘাদ্রীর জুলপির চুলে রুপালি রং ধরেছে পুরুষ্টু গোঁফের পুরুষালি চেহারা, দাড়ি কামানো মসৃণ উজ্জলের গাল, চোখে পাওয়ার চশমার পরিবর্তে গগোল্স এ একেবারে অন্য মানুষ মনে হচ্ছিল। ডক্টর মেঘাদ্রীর বাড়ি যাওয়ার পথে তিঁনি জানালেন যে গত সাত মাস আগে তাঁদের দুই মাসের শিশু কন্যাকে রেখে তাঁর স্ত্রী পরলোক গমন করেছেন। তাঁর বৃদ্ধা মা এখন আর দুরন্ত বাচ্চাকে সামলাতে পারছেন না আর তাঁর ডাক্তারী জীবনে বাচ্চার জন্য যথেষ্ট সময় বের করাও খুব মুশকিল। কোন আয়ার উপরে ও তাঁদের বিশেষ ভরসা নেই।

এখন রচিতার কাছে মোটামুটি স্পষ্ট ডক্টর হিমাদ্রি কি প্রস্তাব দিতে চলেছেন।

অবাক চোখে ডক্টর মেঘাদ্রীর দিকে তাকিয়ে রচিতা বলল- কিন্তু স্যার আপনার মতন একজন ডাক্তারের জন্য আমি কি উপযুক্ত? আপনি তো আমার ব্যাপারে সবকিছুই জানেন তারপরও আপনি আমাকে এই প্রস্তাব কিভাবে দিচ্ছেন আমি সেটা বুঝে উঠতে পারছি না। মৃদু হেসে ডক্টর মেঘাদ্রী বললেন আগে বাড়িতে চলুন তারপর আপনি সব বুঝতে পারবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ডক্টর মেঘাদ্রীর বাড়িতে পৌঁছে গেল। দরজার বাইরে থেকেই রচিতা একটি শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে পেল, কেন জানে না তার বুকটা মুচড়ে উঠলো। দ্রুত ঘরে প্রবেশ করে রচিতা ওয়াকারের বসে থাকা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল এবং পরম মমতায় তাঁর মাথায় গালে চুমু দিতে লাগল। বাচ্চাটাও কান্না থামিয়ে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে রচিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আর মুখ দিয়ে মাম মাম মাম মাম শব্দ বের করছে।

কাছে এসে ডক্টর মেঘাদ্রী বললেন- RD004 আপনি আমার কন্যার গর্ভধারিণী, তাকে বুকের দুধ খাইয়ে একমাস আপনি আপনার কাছে রেখেছিলেন তাই আপনার থেকে উপযুক্ত আমি আর কাউকেই পেলাম না, এখন আপনিই বলুন আপনি কি আমার সন্তানের সত্যিকার মা হতে চান? শিশুকন্যাটিকে বুকে চেপে ধরে ঝর ঝর করে কাঁদতে থাকে রচিতা। তার চোখের জলেই ডক্টর মেঘাদ্রীর সব উত্তর জানা হয়ে যায়।