অবচেতনে
অমৃতা ব্যানার্জী ,
কলকাতা
‘দিদি আপনার চা’ শুনে চোখ মেলে তাকায় দীপশিখা। চোখ-মুখ ধুয়ে এসে চা
নিয়ে জানলার পাশে বসে। জানলার কাঁচ ভেদ করে উজ্জ্বল রৌদ্রকিরণ প্রতিফলিত
হচ্ছে ঘরের শ্বেতশুভ্র দেওয়ালে। পর্দা টেনে দিল দীপশিখা। এখন আর ওর এত
আলো ভালো লাগে না। এই ঘরের সব দেওয়াল শ্বেত বর্ণের। দীপশিখা নিজেও
শ্বেতশুভ্র পোশাক পরে আছে। আজকাল বেশিরভাগ সময় ও শুভ্র বর্ণের পোশাক
পরে। কিন্তু কেন? এই ঘর আর ওর মনের মধ্যে যে অন্ধকারের ঘনঘটা, সেইটা
লুকানোর জন্য কি শুভ্র বর্ণের আস্তরণ? নাকি শ্বেত বর্ণের উপর মলিনতার
চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যায় তাই? দীপশিখা হয়ত প্রতিমুহূর্তে মলিনতার মধ্যে
নিজের প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করতে চায়।
‘দিদি আজ কিন্তু আপনাকে জিমে যেতে হবে। সাহেব বলে গেছেন।’ ঘরে এসে বলে
গেল রুমা। ঘরের মধ্যে জিমের ব্যবস্থা। আবার জিম! প্রচণ্ড বিরক্ত হয়
দীপশিখা। স্বাস্থ্যচর্চার জন্য লোহা টানা ওর অসহ্য লাগে। স্বাস্থ্যচর্চার
কি অন্য কোন উপায় নেই! দীপশিখার বাবা বলতেন বিশুদ্ধ বায়ু বুকে ভরে
প্রাতঃভ্রমণ সবচেয়ে স্বাস্থ্যকরী। ভোরবেলা কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে চাইত
না দীপশিখা। জোর করে বাবা তুলে নিয়ে যেতেন প্রাতঃভ্রমণে। পথে উদাত্ত
কণ্ঠে শুরু করতেন আবৃত্তি। দীপশিখাও বাবার সঙ্গে গলা মেলাতো। উভয়ের
মিলিত কণ্ঠে গর্জে উঠত,
"আজি এ প্রভাতে কর
কেমন পশিল প্রাণের 'পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
……….." সেইসময় প্রভাতের রবিকে স্বাগতম জানাত দীপশিখা। এখন উজ্জ্বল
রবিকিরণে ভয় করে তার।
জিম থেকে বেরিয়ে স্নান করে খেতে বসল দীপশিখা। থালায় রাখা গ্রিন স্যালাড
আর এক বাটি চিকেন স্টু। এইসব খাবারই এখন দীপশিখার জাবরকাটার রসদ।
---- ‘দিদি আমি বাজারে যাব। আপনার জন্য কিছু আনতে হবে?’
---- ‘আমসত্ত্ব এনো।’
---- ‘না দিদি, সেইটা পারব না। স্যার বলে গেছেন, আপনাকে যেন কোন মিষ্টি
খাবার না দেওয়া হয়। আপনার ওজন বেড়ে যাবে।’
ছোটবেলায় দীপশিখা একদম খেতে চাইত না, বিশেষ করে সকালে। মা তখন দুধ, কলা,
আমসত্ত্ব একসঙ্গে মেখে দিয়ে রবি ঠাকুরের সেই ছড়াটি বলতেন,
"আমসত্ত্ব দুধে ফেলি, তাহাতে কদলী দলি,
সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে -
হাপুস হুপুস শব্দ চারিদিক নিস্তব্ধ,
পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।"
দীপশিখা ভাবত ওর খাবারের দিকে ওঁৎ পেতে পিঁপড়ে বসে আছে। ও না খেলে
পিঁপড়ে সব খেয়ে নেবে। এক নিঃশ্বাসে পুরো খাবার শেষ করত। জীবনে নিজের
পছন্দের সব আজ ও ছেড়ে দিয়েছে। শুধু এই আমসত্ত্ব প্রীতি রয়ে গেছে।
সেইটাও আজ কেউ কেড়ে নিল।
রুমা বেরিয়ে গেছে। দীপশিখার জীবনে এখন অখণ্ড অবসর। দীপশিখা এখন যেখানে
থাকে, সেই স্থানকে বাড়ি না বলে মহল বলাই উপযুক্ত। তিন মহলা বাড়ি,
আধুনিক বিলাসবহুল জীবনের উপযোগী সমস্ত সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো। দীপশিখা এই
মহলের রাজরানী, নাকি বন্দিনী!
একসময় দীপশিখার জীবন ছিল মুক্ত বিহঙ্গের মত। রাজমহল ছিল না তার। ছিল
একটুকরো শান্তিপ্রাঙ্গণ। একটি ছোট চার কামরার বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্তের
সংসার, বাবা সুলোচন, মা মৈত্রেয়ী, আর ওঁদের আদরের মেয়ে দীপশিখা। চারটি
ঘরের একটি ছিল বাবা মায়ের শোয়ার ঘর, একটি দীপশিখার। বাকি একটি ঘর ও
বাইরের বসার ঘরে ছিল মায়ের গানের স্কুল। আদর করে মৈত্রেয়ী দেবী ঐ গৃহের
নাম দিয়েছিলেন শান্তিপ্রাঙ্গণ। সুলোচনবাবু ছিলেন রেলকর্মী। অফিস থেকে
ফিরে রোজ করতেন আবৃত্তি চর্চা। শান্তিপ্রাঙ্গণে আলাদা করে কোন ঠাকুরঘর
ছিল না। মৈত্রেয়ী দেবী নিজের সঙ্গীত সাধনার ঘরেই পেতেছিলেন ঠাকুরের আসন।
যে আসনের একদিকে বিরাজমান স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণ, অন্যদিকে বাঙালির
রাজরাজেশ্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভালোবাসার ঐকতানে বাঁধা ছিল তিনজনের
সংসার।
সেই ঐকতান কবে ছিন্ন হয়ে গেছে। আজ দীপশিখা এই সোনার খাঁচায় নির্বাসিতা।
কিন্তু কেন ওর এই নির্বাসন? আপনজনদের ভালোবাসার জন্য নাকি আপনজনদের
অমান্য করার জন্য?
এ’কথা-সে’কথা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় রাখা চেয়ারে এসে বসল দীপশিখা। বেলা
কত হয়েছে খেয়াল নেই ওর। কিন্তু আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে আছে। দিনে যেন
সন্ধ্যা নেমেছে। আচ্ছা দীপশিখা যদি চিৎকার করে এখন বলে মা, "হারিয়ে গেছি
আমি", তোমার দীপশিখা নিভে গেছে, তাহলে তার সেই গগনভেদী কণ্ঠস্বর কি
মায়ের কাছে পৌঁছবে?
সব ভুলের কি প্রায়শ্চিত্ত হয়, নাকি কিছু ভুল সমাপ্তি নির্ধারণ করে?
দীপশিখার বর্তমান জীবন কি তার একদিনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত? নাকি সেই ভুল
তার জীবনের সমাপ্তি রচনা করেছিল? পরিপূর্ণ জীবন ছিল দীপশিখার। বাবা
মায়ের স্নেহ, রবীন্দ্রনাথের আদর্শকে অবলম্বন করে আনন্দে দিন কাটছিল
দীপশিখার। আনন্দের নদীতে নতুন ধারা যুক্ত হল যখন কলেজে চয়নের সঙ্গে আলাপ
হল। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল,
"প্রথম জীবনপথে বাহিরিয়া এ জগতে
কেমনে বাঁধিয়া গেল নয়নে নয়ন।।"
কলেজ পাশ করে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি পায় দীপশিখা। কোম্পানির
মালিক কমল পাণ্ডে প্রথম থেকেই খুব পছন্দ করতেন দীপশিখাকে। কিন্তু
সুলোচনবাবু ও চয়ন কমল পাণ্ডেকে পছন্দ করতেন না। সবসময় দীপশিখাকে বলতেন
কমল পাণ্ডের থেকে দূরে থাকতে। এর মধ্যে একদিন অফিসের কাজে নিজের সঙ্গে
দীপশিখাকে বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব দেন কমল পাণ্ডে। বাবা ও চয়নের কথা
অমান্য করে কমল পাণ্ডের সঙ্গে বাইরে যায় দীপশিখা। একটি হোটেলে ওদের
থাকার ব্যবস্থা ছিল। সেই হোটেলে দীপশিখা জানতে পারে বাবা ও চয়নের ধারণাই
ঠিক। কমল পাণ্ডে অবৈধ কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত। পালিয়ে যেতে চেয়েছিল
দীপশিখা। কিন্তু পারেনি। কমল পাণ্ডে ওকে ধরে ফেলেছিলেন। কমল পাণ্ডে
বলেছিলেন দীপশিখা ওর কথা অমান্য করলে ওর পরিবার ও চয়নের জীবনে নেমে আসবে
চরম বিপদ। আপনজনদের জীবনকে সঙ্কটময় করার সাহস হয়নি দীপশিখার। সেই থেকে
কমল পাণ্ডে দীপশিখার জীবনের মালিক। কমল পাণ্ডে দীপশিখাকে এই রাজপ্রাসাদে
বন্দী করেছেন নিজের ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর জন্য। বিভিন্ন বিদেশী
ক্লায়েন্টকে খুশি করার জন্য ব্যবহৃত হয় দীপশিখা। খাঁচার বাইরে একবারও
বেরোনোর অধিকার নেই দীপশিখার। পরিচারিকা রুমাও বাজারে যায় দরজায় বাইরে
তালা লাগিয়ে।
‘দিদি স্যার ফোন করেছিলেন। আজ রাতে তিনি ফিরবেন না।’ রুমা বাজার থেকে
ফিরে এসে দীপশিখাকে জানায়। একদিনের জন্য হলেও অনেকদিন পরে সামান্য
নিষ্কৃতি অনুভব করে দীপশিখা। টিভি চালিয়ে দেখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছে। সত্যি তো আজ
বাইশে শ্রাবণ, গুরুদেবের প্রয়াণ দিবস। দীপশিখা ভুলে গেছে! বিগত দু’বছরে
ওর জীবন যে দিশায় চলেছে, তাতে ওর আর কিছু মনে থাকে না।
আজকের দিনে শান্তিপ্রাঙ্গণে রবীন্দ্র-সন্ধ্যার আয়োজন হত। বাবার আবৃত্তি,
মা ও মায়ের ছাত্রছাত্রীদের গানে মুখরিত হয়ে উঠত বাইশে শ্রাবণের
সন্ধ্যা। কিন্তু দীপশিখার খুব কষ্ট হত আজকের দিনে। এইদিন ওর প্রাণপুরুষ
ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। আজকের দিনে এত আনন্দ ওর ভালো
লাগত না। মৈত্রেয়ী দেবী মেয়েকে বুঝিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বাঙালির
প্রাণ। দীপশিখাও তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘প্রাণপুরুষ’ বলে ডাকে। তাহলে
ওঁর স্মরণ সভায় শোকের ছায়া নয়, আনন্দের ঝঙ্কার থাকা উচিত। মায়ের
কণ্ঠস্বরে আজও কি রবীন্দ্র-সন্ধ্যা মুখরিত হয়? নাকি দীপশিখার
অনুপস্থিতিতে তানপুরার তার গুলোতে ধুলো জমেছে?
মিউজিক সিস্টেমে অনেকদিন পরে দীপশিখা নিজের পছন্দের রবীন্দ্র সঙ্গীত
বাজালো, "দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে।" কিন্তু একি দরজার কাছে
সত্যি কেউ দাঁড়িয়ে আছে! গলা পেরিয়ে ঝুলন্ত দাড়ি, মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
এ কার অবয়ব দেখছে দীপশিখা! এ যে ওর প্রাণপুরুষ, গুরুদেব! সেই স্নিগ্ধ
হাসি যেন দীপশিখা কে কিছু বলতে চাইছেন। সমস্ত ঘর জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে,
"ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।"
******
আজ বাইশে শ্রাবণ। শান্তিপ্রাঙ্গণে দীর্ঘ তিন বছর পরে আবার রবীন্দ্র
সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। উপরন্তু আদালত আজ কমল পাণ্ডের সাজা ঘোষণা
করেছে। লাল পাড় সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলি ফুলের মালা লাগিয়ে দীপশিখা
তার গুরুদেবকে সাজাতে ব্যস্ত। মৈত্রেয়ী দেবী ও সুলোচনবাবুর মুখে ফিরে
এসেছে সেই পুরোনো হাসি।
এতদিন অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতেন মৈত্রেয়ী দেবী। এইবার তিনি
দীপশিখাকে গাইতে বললেন। "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে" গাইল দীপশিখা।
উপস্থিত প্রত্যেকে জানতে আগ্রহী দীপশিখার জয়যাত্রার কাহিনী।
---- ‘ঠিক এক বছর আগে বাইশে শ্রাবণে আমি হঠাৎ কবিগুরুকে দেখতে পাই। চমকে
উঠেছিলাম, এ কেমন করে সম্ভব ভেবে। পরে বুঝি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম। গুরুদেবের যে অবয়ব আমি সেই রাতে দেখেছিলাম, সেইটা আসলে আমার
মায়ের ঠাকুরের আসনে রাখা চিত্র, যা আমি ছোট থেকে দেখেছি। যে গান আমি
শুনেছিলাম, সেইটা মাকে ছোট থেকে গাইতে শুনতাম। গুরুদেবের লেখনী আমাদের এই
বার্তাই দেয়, নারী যেমন সন্তান পালনের জন্য মমতাময়ী রূপ ধারণ করে,
সেইরকমই অসুর বিনাশের জন্য তাকে খড়্গ ধরতে হয়। গুরুদেবের বার্তাকে
অবলম্বন করে শুরু করি প্রচেষ্টা। সোনার খাঁচায় খুঁজতে শুরু করি অপরাধের
তথ্যপ্রমাণ। সাহস করে রুমার অজান্তে ওর ফোন থেকে চয়নকে ফোন করি। যদিও
জানতাম না চয়ন এত বছরে নম্বর পরিবর্তন করেছে কিনা। কিন্তু ভাগ্যক্রমে
চয়নের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। জানতে পারি আমি নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে চয়ন
পুলিশের চাকরি পায়। পুলিশের চাকরির জন্য কলেজের সময় থেকেই প্রস্তুতি
নিয়েছিল চয়ন। ওর বদ্ধমূল ধারণা ছিল আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার সঙ্গে কমল
পাণ্ডে জড়িত। ও খোঁজ শুরু করে। আমার কাছে যা প্রমাণ ছিল, আমি তুলে দিই
চয়নের হাতে। উভয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় কমল পাণ্ডে আজ কারাগারে।
আসলে আমরা মাধ্যম মাত্র। আমাদের চালিকাশক্তি তো গুরুদেব। ওঁর বার্তা যদি
আমার সেইরাতে মনে না পড়ত, তাহলে আজও আমি বন্দী জীবন অতিবাহিত করতাম।
সবাই বলে, "যার কেউ নেই তার ভগবান আছেন"। আমি বলব যে বাঙালির কেউ নেইহ
তার রবীন্দ্রনাথ আছেন। গুরুদেব ওঁর লেখনীতে বলেছেন " তখন আমায় নাইবা মনে
রাখলে"। কিন্তু তিনি আপামর বাঙালীর মনে যে ভালোবাসার আঁচড় কেটেছেন, তা
কোনকালেই ভোলার নয়। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ তিনি শুধু দেহত্যাগ
করেছিলেন। কিন্তু গুরুদেবের প্রাণের স্পন্দন আপামর বাঙালীর হৃদয়ে
অনুরণিত হয়ে চলেছে। তিনি বিরাট সত্ত্বায় আমাদের সকলের মধ্যে
বিরাজমান।’
অনুষ্ঠানের শেষে চয়নকে মঞ্চে তোলা হয়েছে দীপশিখার সঙ্গে গলা মেলানোর
জন্য। উভয়ের মিলিত কণ্ঠ গুরুদেবের দিকে চেয়ে বলছে, "চরণ ধরিতে দিও গো
আমারে"।